এক সপ্তাহের মধ্যেই কি নৈতিক অনুমোদন পাচ্ছে গ্লোব বায়োটেক এর ‘বঙ্গভ্যাক্স’?

Published on: April 25, 2021

২৫ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বায়োটেকের ভ্যাকসিনের নৈতিক অনুমোদন দেয়া হবে, মানবদেহে চালানো হবে পরীক্ষামুলক প্রয়োগ’ শীর্ষক একটি পোস্ট যমুনা টিভির উদ্ধৃতি দিয়ে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে ফেইসবুকে শেয়ার হয়েছে বহু পেইজ থেকে। বাস্তবে এটি একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য। গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত ‘বঙ্গভ্যাক’ করোনার টিকার নৈতিক অনুমোদনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছির আলী। 

 

২৫ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ‘এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্লোব বায়োটেকের টিকার নৈতিক অনুমোদন’ শিরোনামে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যমুনা টিভি যেখানে বলা হয়েছে,

“সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশে উৎপাদিত গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিনের নৈতিক অনুমোদন দিতে পারে বিএমআরসি বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছির আলী বর্তমান পরস্থিতি বিবেচনা করে সরকারের কাছে নৈতিক অনুমোদনের আবেদন করা হয়েছে এক সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদী

প্রতিবেদনে দেয়া সাক্ষাতকারে ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছির আলী বলেছেন,

এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা আমি গত বৃহষ্পতিবার সরকারকে জানিয়েছি যে এটা জরুরি ভিত্তিতে আমাদের কাজ করার অনুমতিটা দেয়া হোক খুবই আশাবাদী যে এই সপ্তাহের মধ্যেই আমরা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিব

যমুনা টিভির ভিডিও প্রতিবেদনের শিরোনামেই ‘এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্লোব বায়োটেকের টিকার নৈতিক অনুমোদন’ লিখে বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছে। প্রতিবেদনে যদিও স্পষ্ট যে এই অনুমোদনের সম্ভাবনার কথাই বলা হয়েছে কেবল ।

সরকার থেকে এবিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসার আগেই যমুনা টিভির বরাত দিয়ে ফেইসবুকে ‘ব্রেকিং নিউজ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই নৈতিক অনুমোদন পাচ্ছে গ্লোব বায়োটেক এর ভ্যাকসিন’ এবং মানবদেহে চালানো হবে পরীক্ষামুলক প্রয়োগ‘ শীর্ষক আটত্রিশ টি পোস্ট দেখা যাচ্ছে Defence Research Forum, বিজ্ঞানচিন্তা, News24, The Bangladesh Today ইত্যাদি ফেইসবুক পেইজ, ভেরিফাইড প্রোফাইল এবং গ্রুপে।

ডিফেন্স রিসার্চ ফোরামের পোস্টটিতেই ৬,৪০০ জন রিএক্ট করেছেন। মোটের ওপর এই পোস্ট গুলোতে আজ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কমেন্ট, লাইক, শেয়ার সব মিলিয়ে ৯,৮৯০ টি প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

এবিষয়ে বিভ্রান্তিকর শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক আমাদের সময় এবং সময় নিউজ ডট টিভি নামের দুই সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যম দুটি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে,

বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকের করোনার টিকাবঙ্গভ্যাক্সএক সপ্তাহের মধ্যেই নৈতিক অনুমোদন দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী

অথচ ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী যমুনা টিভিকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে তিনি আশাবাদী।

অন্যদিকে আজ দুপুরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিএমআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “আমার নাম দিয়ে কোনো কোনো গণমাধ্যম একসপ্তাহের মধ্যে “বঙ্গভ্যাক্স” অনুমোদন পাবে বলে যে খবর প্রচার করছে তা সঠিক নয়।“

গবেষণায় নৈতিক অনুমোদন কি?

মনে রাখা প্রয়োজন যে এই “নৈতিক অনুমোদন” মানে কিন্তু তা জনসাধারণের ওপর প্রয়োগ করার চূড়ান্ত অনুমোদন নয়। ‘নৈতিক অনুমোদন’ বা (এথিকাল ক্লিয়ারেন্স) বলতে গবেষণায় ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পূর্বে এথিকাল কমিটির কাছ থেকে মানুষের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষার যে অনুমোদন নিতে হয় তার কথা বোঝায়। গবেষণায় নৈতিক অনুমোদন গবেষকদের জন্য অবশ্য অনুসরণীয় যাতে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সম্মান, অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে।

ক্লিনিকাল ট্রায়ালের কোন পর্যায়ে আছে গ্লোব বায়োটেক এর ‘বঙ্গভ্যাক্স’?

সাধারণত একটি টিকা আবিষ্কারের পর হতে তা জনসাধারণের জন্য বাজারে আসতে প্রায় ৫টি ধাপ পার করতে হয়।  প্রথমে  বিজ্ঞানীরা ইঁদুর বা বানরের মতো প্রাণীগুলোর ওপর টিকা প্রয়োগ করেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে কিনা তা দেখার জন্য, একে প্রি-ক্লিনিকাল টেস্টিং বলা হয়। গ্লোব বায়োটেক এখনও পর্যন্ত তাদের টিকা পরীক্ষা করেছে ইঁদুরের ওপর। এবছর ১৭ই জানুয়ারি গ্লোব বায়োটেক ক্লিনিকাল ট্রায়ালের একসঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের অনুমোদন চেয়ে বিএম‌আরসি-র কাছে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার আবেদন জমা দেন।

ক্লিনিকাল টেস্টিং-এর প্রথম ধাপে গবেষকরা অল্প সংখ্যক মানুষের ওপর এটি পরীক্ষা করে দেখেন তাদের শরীরে জীবাণুটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে কিনা।

তার পরে দ্বিতীয় ধাপটি হচ্ছে একটি সম্প্রসারিত পরীক্ষা যেখানে গবেষকরা শিশু, প্রবীণ সহ বিভিন্ন বয়স ভেদে প্রতি ১০০ জনের একেকটি দলের ওপর টিকাটি প্রয়োগ করে দেখেন এর পার্শপ্রতিক্রিয়াসমূহ। এই ধাপটিতে ফলাফল ইতিবাচক দেখা গেলে শুরু হয় টিকাটির কার্যক্ষমতা পরিমাপের ধাপ।

তৃতীয় ধাপটিতে গবেষকরা টিকাটি হাজার খানেক স্বেচ্ছাসেবী মানুষের ওপর প্রয়োগ করে দেখেন কত জন মানুষ নতুন জীবাণুটিতে আক্রান্ত হয়। এই পরীক্ষাটি নির্ধারণ করে দেয় টিকাটি নতুন জীবাণুটির বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করতে পারবে কিনা।

চতুর্থ ধাপে দেখা হয় জীবাণুটির বিরুদ্ধে সফলভাবে লড়াই করতে টিকাটি কতটুকু সক্ষম ও নিরাপদ। যদিও এই ধাপে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি থেকেই যায়।

পঞ্চম ধাপে প্রতিটি দেশের টিকাটির পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে তা অনুমোদন দেয়া হয়। যদি গবেষকরা স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে উদ্বেগজনক কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া পান তখন তারা টিকা প্রদান তাৎক্ষণিক থামিয়ে দেন। তবে মহামারী চলাকালীন একটি টিকা আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের আগে মৃদু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াসহ জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেতে পারে। যেমনটি পেয়েছে বিশ্বের কয়েকটি বিখ্যাত টিকা উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত টিকা ও বঙ্গভ্যাক্সের তূলনামূলক অবস্থান  নীচের সারণীতে তুলে ধরা হল:

ফাইজার মডার্না অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা স্পুটনিক ৫ বঙ্গভ্যাক্স
৩য় ধাপ

(বিভিন্ন দেশে অনুমোদিত হয়েছে এবং জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে)

৩য় ধাপ

(বিভিন্ন দেশে অনুমোদিত হয়েছে এবং জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে)

৩য় ধাপ

(বিভিন্ন দেশে অনুমোদিত হয়েছে এবং জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে)

৩য় ধাপ

(বিভিন্ন দেশে অনুমোদিত হয়েছে এবং জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে)

প্রি-ক্লিনিকাল টেস্টিং

(১ম ধাপের নীচে) অর্থাৎ বঙ্গভ্যাক্স এখনও মানবদেহে পরীক্ষা করার অনুমোদনই পায়নি

 

*ফাইজার , মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও স্পুটনিক ৫-বিষয়ক তথ্যের উত্স:  নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ভ্যাকসিন ট্র্যাকার 





তথ্যসূত্র

ফেইসবুক পোস্ট ১

ফেইসবুক পোস্ট ২

যমুনা টিভির প্রতিবেদন

আমাদের সময়ের প্রতিবেদন

সময় নিউজের প্রতিবেদন

“বঙ্গভ্যাক” করোনার টিকার অনুমোদনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি : বিএমআরসি চেয়ারম্যান

Coronavirus Vaccine Tracker

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab

Leave a Reply