ভাইরাল হওয়া ছবির বাবা ও মেয়ে কি ফুলপুরের মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে?

Published on: August 20, 2020 

ফুলপুরে ১৮ই আগস্ট ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাস্থলের একটি ছবি এমনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে যেন শিশুটিকে জড়িয়ে থাকা লোকটি তার বাবা এবং দুর্ঘটনায় তারা দুজনেই প্রাণ হারিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ছবিতে দেখা যাচ্ছে শিশুটির চাচাকে। দুর্ঘটনায় নিহত শিশু বুলবুলির বাবা শাহজাহান ও চাচা শরফুল আহত হলেও মৃতুবরণ করেন নি।

মঙ্গলবার ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহের ফুলপুরে মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে শিশুসহ আট জন নিহত হয়। দুর্ঘটনার সংবাদ দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলিতে ব্যপকভাবে প্রচারিত হয়।

ভাইরাল ছবি 

সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনগুলির সাথে সাথে একটি ছবি বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উপস্থাপনার ভঙ্গি এবং শিরোনামের ভিত্তিতে ছবিটি দেখে এমন ধারনা তৈরি হয় যে শিশুটিকে জড়িয়ে থাকা লোকটি তার বাবা এবং দুর্ঘটনায় তারা দুজনেই প্রাণ হারিয়েছে। এতে আবেগাপ্লুত হয়ে ফেইসবুকে অনেকেই ছবিটি শেয়ার করেন।

ফেসবুক স্ক্রিনশট:

 

 

 

 

 

 

 

 


যেমন, দৈনিক ভোরের পাতার  ১৮ আগস্ট, অনলাইন সংস্করণের তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে- “ওই ঘটনার পর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন বাবা তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন। তবে তাদের ততক্ষণে প্রাণ চলে গেছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ওই অবস্থায়ই তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।”

দৈনিক ভোরেরপাতা প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট

 

দৈনিক ইনকিলাব লিখেছে, “শিশু বুলবুলি আক্তার (৭) বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই মৃত্যু বরণ করেন। মাইক্রোবাস রাস্তার পাশের পানিতে ডুবে গেলে নিজ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রক্ষার শেষ চেষ্টা করে বাবা শাহজাহান। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আদরের মেয়েকে বুক থেকে ছাড়েননি এই বাবা। মৃত্যুর অন্তিম মূহুর্তে বাবা কন্যাকে ছেড়ে যায়নি। নিজের শেষ শক্তিটুকুও ব্যায় করে চেয়েছিলেন কন্যাকে বাঁচিয়ে তুলতে। অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে যাওয়া নিশ্চিত জেনে পরম মমত্ববোধে আগলে নিয়েছেন নিজের বুকে। বাবার বুকের মাঝেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মেয়েটি।”

এরকম খবর আরো পাওয়া যায় আলোকিত বাংলাদেশে: “ফুলপুরে বাবার বুকেই মারা গেলো বুলবুলি” এবং সিলেট প্রতিদিন 24-এ: “বাবার বুকে জড়িয়েই শেষ বিদায় নিলো বুলবুলি”।

 

সাংঘর্ষিক প্রতিবেদন 

অন্যদিকে, ভোরের কাগজের প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, ছবিতে যে ব্যক্তি শিশু বুলবুলির নিষ্প্রাণ দেহ জড়িয়ে ধরে আছে, তিনি মারা যাননি এবং তার নাম শরীফুল। সম্পর্কে তিনি বুলবুলির বাবা নন, চাচা। দুর্ঘটনার পর শরীফুল তার সন্তানতুল্য ভাতিজি মৃত লাশ দেখে আহাজারি শুরু করলে, দৃশ্যটি দেখে অনেকেই ভেবে নেয় তারা বাবা-মেয়ে। শারফুল-ও নালিতাবাড়ীতে খালাতো ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন একই গাড়িতে করে।

ঢাকা অর্থনীতি নামের অনলাইন পত্রিকায় ১৯ এ আগস্ট ঐ ঘটনার একটি সংশোধনী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘বাবা নয়, ভাতিজির লাশ বুকে নিয়ে চাচার আহাজারি’-এই শিরোনামে। সেখান থেকে জানা যায়, বুলবুলির পিতার নাম শাহজাহান। তিনিও ওই মাইক্রোবাসে ছিলেন। দুর্ঘটনার পর তিনি বেঁচে ফিরলেও বাঁচতে পারেনি মেয়ে বুলবুলি। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি ঢাকা অর্থনীতির প্রতিবেদকের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। শাহজাহান বলেন, “আমার ভাই শরীফুল আমার শিশুকন্যা বুলবুলিকে পানি থেকে উদ্ধার করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখেন। কিন্তু আমার মেয়ে ততক্ষণে মারা গেছে। অনেকেই বাবা-মেয়ে বলে যা লিখছেন, তা ঠিক নয়।”

বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ প্রতিনিধি বিভিন্ন সংবাদ মধ্যমে যোগাযোগ করলে, দৈনিক ভোরের পাতানতুন সময়ে তথ্যের ভুল স্বীকার করে এবং সেগুলো সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেয়। যোগাযোগের কিছুক্ষণ পর নতুনসময় তাদের সাইট থেকে সংবাদটি সরিয়ে ফেলে।

মাইক্রোবাসের ভুয়া ছবি

প্রথম সারির  দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারএর প্রতিবেদনে প্রকাশিত ছবিতে আমরা সেখানে দেখতে পাই দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি কালো রঙের। অন্যদিকে, বৈশাখী নিউজপ্রবাসীর দিগন্ত একটি সাদা মাইক্রোবাসের ছবি জুড়ে দেয়, যার কোন উত্স উল্লেখ করা নেই। গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ দিয়ে অবশ্য এই সাদা মাইক্রোবাসের ছবিটির বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।

বৈশাখী প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি
ডেইলি স্টার প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি

 

 

 

 

 

 

 

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

মূল দুর্ঘটনার তথ্য সঠিক হলেও দুর্ঘটনায় নিহত বুলবুলির বাবা শাহজাহান ও চাচা শরফুল আহত হলেও মৃতুবরণ করেন নি। আবেগতাড়িত অতিরঞ্জনের কারণে ছবি ও শিরোনামের ভিত্তিতে বুলবুলির সাথে সাথে তার বাবা-র মৃত্যুর কথা ছড়িয়ে পড়ে। সেইসাথে, অন্য কোন দুর্ঘটনকবলিত সাদা মাইক্রোবাসের ছবি কোন ব্যাখ্যা ছাড়া এই ঘটনার খবরে ব্যবহার করায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।অতএব, ছবিতে দুর্ঘটনায় মৃত বাবা ও মেয়েকে দেখা যাচ্ছে এই দাবিটি ফ্যাক্টওয়াচের বিশ্লেষণে অর্ধসত্য।

তথ্যসূত্র

দৈনিক ভোরের পাতা 

দৈনিক ইনকিলাব

আলোকিত বাংলাদেশে

সিলেট প্রতিদিন 24

ভোরের কাগজ

নতুন সময়

প্রথম আলো

ডেইলি স্টার

বৈশাখী নিউজ

প্রবাসীর দিগন্ত

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab

Leave a Reply