অক্সিজেট: উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহে বুয়েটের উদ্ভাবিত যন্ত্র

Published on: July 30, 2021

আপন দাস 

কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় উচ্চমাত্রার অক্সিজেনের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের হাসপাতালে সাধারণ বেডে একজন রোগীকে অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায়। যখন রোগীর এর থেকে বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে, তখন হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা অথবা আইসিউ’র প্রয়োজন হয়। বর্তমানে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে একই সঙ্গে আইসিউ শয্যা এবং অক্সিজেনের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রয়েছে উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র হাই-ফ্লো নাজাল ক্যানুলার সংকটও। এসময় কোভিড আক্রান্ত রোগীদের উচ্চমাত্রার অক্সিজেনের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) উদ্ভাবিত স্বল্প খরচের যন্ত্র ‘অক্সিজেট’ আশার আলো দেখাচ্ছে।

 

কি এই ‘অক্সিজেট’ ?

সম্প্রতি বুয়েটের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ এক বছরের প্রচেষ্টায় তৈরি করেছে ‘অক্সিজেট’ নামক একটি যন্ত্র যা দিয়ে হাসপাতালের সাধারণ বেডেই কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ৬০ লিটার পর্যন্ত উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দেয়া যাবে। এই উদ্ভাবনার নেতৃত্বে ছিলেন বুয়েটের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডক্টর তওফিক হাসান। তার সাথে ছিলেন তারই চার ছাত্র মীমনুর রশিদ, ফারহান মুহিব, কায়সার আহমেদ ও কাওসার আহমেদ। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের সহযোগিতা করেন জৈবচিকিৎসা প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ তারিক আরাফাত, সহকারী অধ্যাপক জাহিদ ফেরদৌস ও সাঈদুর রহমান। যেসব অঞ্চলে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা অথবা আইসিউ’র সংখ্যা কম, সেখানে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের ক্ষেত্র্রে এই যন্ত্রটি  কাজে আসবে বলে মনে করছেন উদ্ভাবকগণ। এই যন্ত্রটির উৎপাদন খরচও বেশ কম এবং এটি বিদ্যুৎ ছাড়াই চলে।

ডক্টর তওফিক হাসান প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে অক্সিজেট নিয়ে কাজ শুরু করেন তাঁরা। পরে সরকারের আইসিটি বিভাগের উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ (আইডিয়া) শীর্ষক প্রকল্প, অঙ্কুর ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ও মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ সহায়তা দেয়। এই কাজে এখন পর্যন্ত ১৫-২০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য তাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। যন্ত্রটির অনুমোদনের জন্য শিগগিরই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে (ডিজিডিএ) আবেদন করবেন তাঁরা।

‘অক্সিজেট’ যেভাবে কাজে লাগবে

কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের যে শ্বাসতন্ত্রটি সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি হচ্ছে ফুসফুস। যারা গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা প্রয়োজনের তুলনায় স্বাভাবিকভাবে অক্সিজেন নিতে পারেন না। ফলে এসব রোগীর একটি বড় অংশের চিকিৎসায় কৃত্রিমভাবে উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশের হাসপাতালের সাধারণ বেডে একটি ১৫ লিটারের অক্সিজেন ফ্লো-মিটার থাকে যার সাহায্যে মাস্কের মাধ্যমে রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। এর থেকে বেশী মাত্রায় অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে রোগীর প্রয়োজন পড়ে হাই-ফ্লো নাজাল ক্যানুলা যা দিয়ে প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ৭০ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা যায় রোগীকে। বর্তমানে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় যে সরঞ্জামগুলোর চাহিদা শীর্ষে রয়েছে, হাই-ফ্লো নাজাল ক্যানুলা তার মধ্যে একটি।

‘অক্সিজেট’ এর উদ্ভাবকরা বলছেন, তারা এই যন্ত্রের মাধ্যমে আইসিউ’র রোগী কমাতে চান। এটি ১৫ লিটার অক্সিজেন ফ্লো-মিটারের সাথে যুক্ত করলে এটি পরিবেশ থেকে আরও বাতাস যুক্ত করে ৬০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেনযুক্ত বাতাস তৈরি করতে পারে। এই ৬০ লিটার অক্সিজেন যদি মাস্কের মাধ্যমে রোগীকে দেয়া হয়, এটি সি-প্যাপ ভেন্টিলেটর হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে যে মাস্কটি ব্যবহার করা হয় তাকে বলে নন-ভেন্টেড সিপ্যাপ মাস্ক। এটি রোগীর মুখে আঁটসাঁট ভাবে লেগে থাকে যাতে অক্সিজেনযুক্ত বাতাস বের হয়ে যেতে না পারে। এর সাথে যুক্ত থাকে একটি পিপ-ভাল্ব যা অক্সিজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

কোভিড -১৯ মহামারীতে বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর রোগীর চাপ সামলাতে অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা যুক্ত হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে একটি হাই-ফ্লো নাজাল ক্যানুলার দাম সাড়ে ৪ লাখ টাকা এবং সি-প্যাপ ভেন্টিলেটরের দাম প্রায় ১ লাখ টাকা। এর বিপরীতে, অক্সিজেট ডিভাইসটির দাম মাত্র  ২০ ডলার যা  এর সমস্ত আনুষাঙ্গিকের সাথে একটি সম্পূর্ণ সেট বানাতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। এছাড়াও, হাই-ফ্লো নাজাল ক্যানুলার মতন যন্ত্রগুলো বিদ্যুতে চালিত হয়, সেখানে অক্সিজেটের জন্য বিদ্যুতেরও দরকার পড়ে না।

 

সীমিত আকারে উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমোদন পেল ‘অক্সিজেট’

উদ্ভাবনের কিছু মাস পর বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ যন্ত্রটি ব্যবহারের অনুমোদন দিলেও প্রয়োজন ছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন। সে জন্য যন্ত্রের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার পরামর্শ দিয়েছিল হাইকোর্ট। অবশেষে ২৮ জুলাই ২০২১ (বুধবার) অক্সিজেটের সীমিত আকারে উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ড. তৌফিক হাসান বণিক বার্তাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “প্রাথমিকভাবে ২০০ ইউনিট উৎপাদন করবেন তারা। এরপর সেগুলোর ব্যবহার ও উপযোগিতা দেখে আরো পরিসরে উৎপাদনের অনুমতি পাওয়া যাবে। আমরা চাই অক্সিজেনের উচ্চমূল্য যেন চিকিৎসার বাধা না হয়। অক্সিজেটের মাধ্যমে অত্যন্ত স্বল্প খরচে উচ্চচাপের অক্সিজেন উৎপাদন করা যাবে। “

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply