ভারতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কি আসলেই তেমন কোনো আলোচনা হয় না?

২৯শে জুলাই, ২০১৮ এয়ারপোর্ট রোডে বাস চাপায় ২ শিক্ষার্থী নিহত হবার ঘটনা নিয়ে উত্তাল দেশ। এরই মাঝে নৌপরিবহন মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন,

“গতকাল আপনারা লক্ষ্য করেছেন, ভারতের মহারাষ্ট্রে একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে ৩৩ জন মারা গেল। এখন সেখানে কি আমরা যেভাবে এগুলোকে নিয়ে কথা বলি এগুলো কি ওখানে কথা বলে?”

 

নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্য:

মহারাষ্ট্রের সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনাটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় কবলিত বাসটি ছিলো ড. বেলাসাহেব শান্ত কনকান বিদ্যাপীঠ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাসটি পাহাড়ি রাস্তায় চাকা পিছলে গিয়ে প্রায় ৫০০ ফুট নিচে খাদের ভেতর পড়লে বাসে থাকা ৩৪ জনের ভেতর ৩৩ জনেরই মৃত্যু হয়। ভারতের এই বাস দুর্ঘটনাটি ঘটেছে পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তায়। আর ঢাকা শহরের দুর্ঘটনাটি ছিলো এয়ারপোর্টের কাছে সোজা রাস্তায়। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তফাত হলো, ঢাকার এই দুর্ঘটনায় দুটি বাস ক্যান্টনমেন্টের স্কুল-কলেজের পাশের রাস্তায় আগে যাবার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের উপর তুলে দেয়।

নৌপরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্যের যৌক্তিকতা যাচাইয়ে ভারতে গত কয়েক মাসে হওয়া চারটি সড়ক দুর্ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে ফ্যাক্ট-ওয়াচ। এই তিনটি দুর্ঘটনার ভেতর প্রথমটি সম্পর্কে বলা হয়েছে উপরে। বাড়তি তথ্য হিসেবে যা পাওয়া গিয়েছে সেটা হলো, এই দুর্ঘটনাটি ভারতে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে আলোচিত সংবাদগুলোর মধ্যে একটি। তবে এ নিয়ে সরকার বা প্রশাসনের কারো দিকে আঙ্গুল তোলেনি ভারতের জনগণ। বাসের মালিকের পরিচিত নন ভারতের কোনো মন্ত্রী। আর এই দুর্ঘটনা নিয়ে সরকারের কেউ বিতর্কিত কোন মন্তব্যও করেনি। বরং প্রশাসনের দিকে আঙ্গুল তোলার মতন পরিস্থিতি তৈরি হবার আগেই প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সবশেষে মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে চার লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার।

 

ভিডিও: বিহারের গাওয়াতে সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ।

দ্বিতীয় সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ফেব্রুয়ারিতে ভারতের গুজরাট প্রদেশের ভাদোদারা শহরে। “আম্বে গ্রুপ অফ স্কুলস”-এর ১৩ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী সাইকেল ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। মৃত্যুর পর থেকে আন্দোলনে নামে ঐ এলাকায় স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরা। দুটি ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন অল গুজরাট ভালি মন্ডল (এজিভিএম) এবং ভাদোদারা প্যারেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ভিপিএ) স্কুল গেটের বাইরে শোক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে স্কুলটির ট্রাস্টিদেরকে গ্রেফতার, বড় রাস্তার পাশে অবস্থিত স্কুলগুলির স্থান পরিবর্তন এবং মৃত শিক্ষার্থীর পরিবারকে পনেরো লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবার দাবি করা হয়।

তৃতীয় সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের জুন মাসে ভারতের ভুবনেশ্বরে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় তিনজন, যার ভেতর দুইজন স্কুল শিক্ষার্থী। তিনজনই একটি মোটরসাইকেলে ছিলো। যেটি রাস্তায় থাকা জেসিবি এক্সকাভেটরে আঘাত হানলে মারা যায় মোটরসাইকেলে থাকা তিনজনই। ঘটনার পর স্থানীয়রা রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করে। এক পর্যায়ে রাস্তা মেরামতের জন্যে আনা সেই এক্সকাভেটর, চারটি ট্রাক এবং রাস্তা মেরামতের জন্যে তৈরি করা অস্থায়ী ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত গ্রামবাসী।

ভারতের মিডিয়ায় প্রায়শই আলোচনা হয় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে।

 

অন্ধ প্রদেশের বিজয়ওয়াডা শহরের একটি ব্যস্ত রাস্তায় গত বছরের ২৭ অক্টোবর বাসের নিচে প্রাণ হারায় আরও তিনজন। দুর্ঘটনাটি ঘটার পেছনে বাসের ব্রেক ফেইলার দায়ী থাকলেও দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তদের আত্মীয়-স্বজন সেই বাসে ভাঙ্গচুর চালায় এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। পরবর্তীতে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।

ভারতের সড়ক দুর্ঘটনার অভিযোগ থেকে রেহাই পায় না প্রভাবশালী বা জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরাও। ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সালমান খানের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার বান্দ্রার “আমেরিকান এক্সপ্রেস বেকারি”-তে আঘাত করলে একজন মারা যায় এবং চারজন আহত হয়। পরবর্তীতে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাঁচ বছরের জেল হয় সালমান খানের।

উপরের চারটি দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে ফ্যাক্ট-ওয়াচ এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, দুর্ঘটনার স্থান এবং ধরন বিবেচনা করলে মহারাষ্ট্রে হওয়া সড়ক দুর্ঘটনার সাথে ঢাকার দুর্ঘটনার তুলনা কোনোভাবেই করা যায় না। অপরদিকে গুজরাট এবং ভুবেনশ্বের দুর্ঘটনা নিয়ে প্রচুর আলোচনা, বিক্ষোভ এবং আন্দোলন হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ভারতে গণপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে নৌপরিবহন মন্ত্রীর দাবিটি বাস্তবের সাথে মেলে না।

Leave a Reply