মাংসখেকো মারাত্মক এক যৌনবাহিত রোগ ফিরে আসছে কি?

গত আগষ্ট মাস থেকে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি সংবাদে দাবি করা হচ্ছে যে, গবেষকরা ডোনোভানোসিস নামক একটি মাংসখেকো যৌনবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপুলভাবে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে এই সংবাদটি। গত দুই সপ্তাহে একের পর এক পোস্ট এসেছে ডোনোভানোসিস নিয়ে।

অনলাইনের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং ফ্যাক্ট-চেকিং সাইটের অনুসন্ধান পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে যে এই সংবাদটি আংশিক সত্য। জনপ্রিয় ফ্যাক্টচেকিং সাইট “স্নুপস” এই সংবাদটিকে “মিশ্র” রেটিং প্রদান করেছে।

দাবিতে উল্লেখ করা যৌনবাহিত রোগ ছড়িয়ে পরার সংবাদটি সত্যি। এ বিষয়ে পৃথক পৃথক সংবাদ করেছে যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম মিরর এবং এক্সপ্রেস। তাদের সংবাদে রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদানের পাশাপাশি বলা হয়েছে যে, এই রোগটি হবার পর দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করালে যৌনাঙ্গে আলসারের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে যৌনাঙ্গের আশেপাশে থাকা কোষগুলি নিজেরাই নিজেদেরকে খেয়ে ফেলে বা ধ্বংস করে ফেলে।

এক্সপ্রেসের সংবাদে আরও বলা হয়, এই রোগ হবার পেছনে দায়ী ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে আসার ১২ সপ্তাহ পর রোগটি বোঝা যায়। তখন যৌনাঙ্গের আশেপাশে লাল লাল ফোলা অংশ দৃশ্যমান হয়। এগুলি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং একটা পর্যায়ে আশেপাশের সুস্থ্য মাংসপেশীগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে।

তবে সংবাদটি সত্যি হলেও গবেষকদের সতর্কতা জানানোর ব্যাপারটি সত্যি নয়। পুরো সতর্কতাটি এসেছে যুক্তরাজ্যের প্রশাসনের কাছ থেকে। ইংল্যান্ডের এক নারী ডোনোভানোসিসে আক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে ১২ মাসের মধ্যে চিকিৎসা না করালে সমস্যা হবে বলে সতর্কতা প্রদান করে প্রশাসন। তবে এই সতর্কতা আসলে প্রশাসনের কোন অংশ থেকে এসেছে সেটি নিয়ে কোনো তথ্য প্রদান করেনি বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম। তবে যৌন রোগ নিয়ে যুক্তরাজ্যে কাজ করে যাওয়া প্রতিষ্ঠান বৃটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সেক্সুয়াল হেলথ অ্যান্ড এইচআইডি (বাশশ)-এর ওয়েবসাইটে ডোনোভানোসিস সংক্রান্ত একটি গাইডলাইন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, ডোনোভানোসিস রোগটি খুবই কম মানুষের হয়। এবং গত বারো মাসে মাত্র একজনের ভেতর রোগটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এখনো তেমন করে ভয়াবহমাত্রায় ছড়িয়ে পড়েনি রোগটি। আর এটি যত ভয়াবহই হোক না কেন, সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েই মুক্তি পাওয়া যায় এটি থেকে।

সংবাদটি নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক তৈরি করেনি যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু মিডিয়া আউটলেট ডোনোভানোসিসের ব্যাপারটিকে একটু বাড়তি সেনসেশন প্রদান করতে গিয়ে তৈরি করেছে বিতর্কের। ফক্স নিউজ এমন একটি শিরোনাম প্রদান করেছে যেটি পড়লে স্বভাবতই পাঠকরা ভাববেন ডোনোভানোসিস একটি মহামারী রোগ। তবে সংবাদের প্রথম লাইনে “রেয়ার” শব্দটি ব্যবহার করে ব্যাপারটি ঠিক করেছেন তারা। ফক্স নিউজের প্রতিবেদনেই বলা আছে যে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডেই প্রায় ৪২০,০০০ যৌনবাহিত রোগের রোগী পাওয়া গিয়েছে। সেখানে কেবলমাত্র মাত্র একজন ডোনোভানোসিস রোগীর জন্যে “’Flesh-eating’ STD allegedly making the rounds” শিরোনাম প্রদান করে পাঠকদের বিভ্রান্ত করার ব্যাপারটি মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেকটি সংবাদমাধ্যম এবিসিসেভেননিউজ আরও এক ধাপ উপরে গিয়েছে তাদের শিরোনাম নিয়ে। তারা তাদের শিরোনামে সরাসরি উল্লেখ করেছে যে “গবেষকরা” ইংল্যান্ডে মাংসখেকো যৌনবাহিত রোগের সন্ধান পেয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে।

সবগুলি প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ল্যাঙ্কাশায়ার পোস্টের একটি প্রতিবেদনকে; যেটি রোগটি সম্পর্কে একটি খুব স্পষ্ট ধারণা দেয়। সেই সংবাদে ডোনোভানোসিস সংক্রান্ত কোনো গবেষণার কথা উল্লেখ করা নেই। বরং বলা আছে যে রোগটি খুবই বিরল। পাশাপাশি, “রোগটি ফিরে এসেছে বা আসছে” বলে কোনো তথ্য ল্যাঙ্কাশায়ার পোস্টের করা প্রতিবেদনে নেই।

এখানে উল্লেখ্য যে, বেশিরভাগ প্রতিবেদনের শিরোনামে “flesh-eating” অর্থাৎ “মাংসখেকো” শব্দটি ব্যবহারের প্রসঙ্গ। এরকম কোনো শব্দ ল্যাঙ্কাশায়ার পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে ব্যবহার করেনি। সুস্থ্য টিস্যুকে ধ্বংস করে দেবার ব্যাপারটি আরও ভয়াবহভাবে উপস্থাপন করতে এরকম শব্দগুচ্ছ বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা যায়। তবে এক্ষেত্রে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলিকে দোষারোপ করে লাভ নেই। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলিও একই কাজ করেছে।

সবশেষে বলা যায়, যৌনবাহিত রোগের ব্যাপারটি মোটেও নতুন কিছু নয়। গনোরিয়া, মেহ, এইডস, সিফিলিসের মতন যৌনবাহিত রোগগুলির ব্যাপারে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। নির্দিষ্ট চিকিৎসায় বেশিরভাগ যৌনবাহিত রোগ (এইডস ব্যতিরেকে) থেকেই আরোগ্য পাওয়া যায়। ডোনোভানোসিসও ব্যতিক্রম নয়। সংবাদটিকে অযথা বাড়তি আকর্ষণীয় করতে গিয়ে পাঠকদের ভেতর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে সংবাদমাধ্যমগুলো।

Leave a Reply