‘বিষাক্ত’ ইয়াবা খেয়ে কি সম্প্রতি কারো মৃত্যু হয়েছে?

Published on: October 24, 2020 

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তৈরি বিষাক্ত ইয়াবা খেয়ে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অনেকে মারা গেছেন বিষয়ক একটি ফেসবুক পোস্ট সম্প্রতি অনেকে শেয়ার করছেন। এই একই পোস্ট ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিলো। পোস্টে উল্লেখিত ঘটনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অতএব ফ্যাক্ট ওয়াচের বিবেচনায় এটি একটি গুজব।

“গতকাল থেকে ইয়াবা সেবনের পরপরই মারা যাচ্ছে“ শিরোনামে একটি পোস্ট সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বিভিন্ন পেইজ, গ্রুপ এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে কপি/পেস্ট করে ছড়িয়ে পড়ছে পোস্টটি। নীচে পোস্টটি হুবাহু তুলে দেয়া হলো:

“গতকাল থেকে ইয়াবা সেবনের পরপরই মারা যাচ্ছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক প্রকার বিষ দিয়ে ইয়াবা বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে। রোহিংগাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। এজন্য মায়ানমার সরকার ইয়াবার সাথে বিষ মিশিয়ে বাংলাদেশের বাজারে ছেড়েছে।

নাখালাপাড়াতে ইয়াবা খেয়ে একজন মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে এই সপ্তাহে। আর গতকাল ৪/৫ জন ইয়াবা খাওয়ার পরে প্রেশার অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। ইমিডিয়েট হসপিটালাইজ করতে হইছে।

মেরুল বাড্ডাতে এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এবং ৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তাদের মুখ দিয়ে লালচে লালা বের হচ্ছে !! মারা যেতে পারে যে কোন মুহূর্তে। যাত্রাবাড়ী ৪ জন মারা গিয়েছে এমন অনেক জায়গায় এসব ঘটনা ঘটছে।

এই খবরটি ছড়িয়ে দিন। ইয়াবা সেবনকারীরা এদেশেরই নাগরিক। কৌশলে ইয়াবা ট্যাবলেটে প্রাণঘাতী উপাদান মেশাচ্ছে মায়ানমার। এই নতুন ইয়াবা সেবনের ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যেই মানুষের সেরিব্রাল এটাক হয় এবং মাথার রক্তনালী ফেটে গিয়ে তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয়। জীবন বাঁচাতে ইয়াবা সেবন থেকে নিবৃত করুন……

কপি- জাতীয় পত্রিকা”


Akbor Haider Munna নামের একটি ফেসবুক কর্তৃক ভেরিফাইড অ্যাকাউন্ট থেকে অক্টোবর ২০, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ, গ্রুপের মাধ্যমে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পরে এবং অনেকেই তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে এটি শেয়ার দিচ্ছেন। যদিও পোস্টটিতে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত কোনো ছবি বা কোনো গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমের সূত্র উল্লেখিত হয়নি। তথ্যসূত্র হিসেবে পোস্টদাতা পোস্টের লেখার শেষে লিখেছন “কপি- জাতীয় পত্রিকা” কিংবা “সংগৃহীত”।

Akbor Haider Munna’র ফেসবুক পোস্ট

 

পুরানো গুজব নতুন করে

তথ্যানুসন্ধানে বের হয়ে আসে, হুবাহু একই পোস্ট ৩ বছর আগে গত ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এভাবেই ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিলো। সেই পোস্টগুলোতেও ঘটনার কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ নেই।

উক্ত সকল পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, “নাখালাপাড়াতে ইয়াবা খেয়ে একজন মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে এই সপ্তাহে। আর গতকাল ৪/৫ জন ইয়াবা খাওয়ার পরে প্রেশার অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। ইমিডিয়েট হসপিটালাইজ করতে হইছে। মেরুল বাড্ডাতে এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এবং ৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তাদের মুখ দিয়ে লালচে লালা বের হচ্ছে !! মারা যেতে পারে যে কোন মুহূর্তে। যাত্রাবাড়ী ৪ জন মারা গিয়েছে এমন অনেক জায়গায় এসব ঘটনা ঘটছে।“

অথচ স্থান ভেদে এই ঘটনা গুলোর স্বাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে যখন এই ফেসবুক পোস্টটি ভাইরাল হয়েছিলো সেই সমসাময়িক দৈনিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল সহ অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোয় সেই ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিক কোনো সংবাদ প্রচারিত হয়নি। ‘মৃত’দের পরিচয় মেলেনি এবং তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন এমন কোনো ঘটনার দাবী করেছেন বলেও কোনো তথ্য মেলেনি।

“রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়াতে মায়ানমারের প্রতিশোধ”

যারা এই গুজব ছড়াচ্ছে তাদের ইঙ্গিত:রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়াতে  এইভাবে মায়ানমার প্রতিশোধ নিচ্ছে।পোস্টগুলোর শুরুতে এবং শেষে উল্লেখ করা হয়েছে:

“মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক প্রকার বিষ দিয়ে ইয়াবা বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে। রোহিংগাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। এজন্য মায়ানমার সরকার ইয়াবার সাথে বিষ মিশিয়ে বাংলাদেশের বাজারে ছেড়েছে।“

“কৌশলে ইয়াবা ট্যাবলেটে প্রাণঘাতী উপাদান মেশাচ্ছে মায়ানমার।“

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষদের বাংলাদেশে  আশ্রয় দেয়ার সাথে এই দাবী গুলোর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে এবিষয়ক কোনো সংবাদ প্রচারিত হয়নি। কোনো গবেষণাগারও এসংক্রান্ত কোনো পরীক্ষামূলক বিবৃতি প্রকাশ করেনি। তাই “মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক প্রকার বিষ দিয়ে ইয়াবা বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে“ দাবীটিও উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে ভিত্তিহীন।

গুজব ভিত্তিহীন হলেও বিপদ আসল

সাম্প্রতিক এই গুজবটি ভিত্তিহীন হলেও ইয়াবা একটি ‘এমফিটামিন’ জাতীয় মাদক যা মানবদেহের জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই মাদক গ্রহণে হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।

এ বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ মেন্টাল হেলথের সাইকোথেরাপির অধ্যাপক মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বলেন, “ইয়াবা খেলে মস্তিষ্কের সরু রক্তনালী ছিঁড়ে যেতে পারে। মস্তিষ্কে রক্তপাতও হওয়ার ঘটনাও আমরা পেয়েছি। ব্রেইন ম্যাটার সঙ্কুচিত হয়ে যায়। সেটা যদি ১৫০০ গ্রাম থাকে সেটা শুকিয়ে এক হাজার গ্রামের নিচে নেমে যেতে পারে। জেনেটিক মলিকিউলকেও  নষ্ট করে দিতে পারে। ফলে পরবর্তী প্রজন্মও স্বাস্থ্য-ঝুঁকিতে থাকে।”

নিষিদ্ধ দ্রব্য হিসেবে ইয়াবা কীভাবে তৈরী হয় তার কোন মান নিয়ন্ত্রনের অবকাশ নেই। এতে বিষাক্ত কিছু আছে কি না তার কোন নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। মিয়ানমারের ষড়যন্ত্রের কোন  প্রমাণ পাওয়া না গেলেও ইয়াবা সেবন যে বিপদজনক তা অবিসংবাদিত ।

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত 

২০১৭ সালে যখন এই ফেসবুক পোস্টটি ভাইরাল হয়েছিলো সেই সমসাময়িক দৈনিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেল সহ অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোয় সেই ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিক কোনো সংবাদ প্রচারিত হয়নি। এবারের  পোস্টটিতে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত কোনো ছবি বা কোনো গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমের সূত্র উল্লেখিত হয়নি। তথ্যসূত্র হিসেবে পোস্টদাতা পোস্টের লেখার শেষে লিখেছন “কপি- জাতীয় পত্রিকা” কিংবা “সংগৃহীত”।

‘মৃত’দের পরিচয় মেলেনি এবং তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন এমন কোনো ঘটনার দাবী করেছেন বলেও কোনো তথ্য মেলেনি।রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষদের বাংলাদেশে  আশ্রয় দেয়ার সাথে এই দাবী গুলোর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে এবিষয়ক কোনো সংবাদ প্রচারিত হয়নি। কোনো গবেষণাগারও এসংক্রান্ত কোনো পরীক্ষামূলক বিবৃতি প্রকাশ করেনি।

অতএব, “মিয়ানমার সেনাবাহিনী এক প্রকার বিষ দিয়ে ইয়াবা বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে“ দাবীটি উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে ভিত্তিহীন।

 

ভাইরাল হওয়া অন্যান্য ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশটস্‌

 

তথ্যসূত্র:

অক্টোবর ২০, ২০২০ তারিখের ফেসবুক পোস্ট https://www.facebook.com/munna.bhai.31542/posts/10157390563591541

২০১৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বরে প্রকাশিত ফেসবুক পোস্ট

https://urlzs.com/MogZv

ড. মোহিত কামালের সাক্ষাত্কার 

https://www.bbc.com/bengali/news-44347600

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab