Published on: October 18, 2021
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে হাজী বিরিয়ানি হাউজ এ গন্ডারের মাংস দিয়ে বিরিয়ানী রান্না করা হত -এমন একটি খবর ভাইরাল হয়েছে । অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী এই খবরে বিভ্রান্ত হচ্ছেন । তবে ফ্যাক্ট ওয়াচ এই খবরের কোনো সত্যতা পায়নি। |
গুজবের উৎস
Vision24 নামক ফেসবুক পেজ থেকে ১৬ই অক্টোবর রাত ১১ টা ১১ মিনিটে এই পোস্ট আপলোড করা হয়। দ্রুত এই খবর ভাইরাল হতে থাকে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ।
এমনকি অনেক মূলধারার সংবাদ মাধ্যমেও এই খবরটি প্রকাশিত হয়। যেমন- আর টিভি , বাংলা ভিশন, নিউজ টুয়েন্টি ফোর , বিডি মর্নিং ইত্যাদি । এছাড়া অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টালে এই খবরটি কপি করতে দেখা যায়।
এসব খবরে বলা হয়, শনিবার (১৬ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন সোনাইমুড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ফজলুর রহমান । এ সময় ৭০কেজি গন্ডারের পচা মাংস ফ্রীজ থেকে উদ্ধার করা হয় ।হাজী বিরিয়ানি হাউজের মালিককে ৩০,০০০ টাকা জরিমানা ও দোকান সিলগালা করে দেওয়া হয়।
ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান
News24BD নামক পেজ থেকে গতরাতে একটি ৭ মিনিটের ভিডিও আপলোড করা হয়। এখানে নাম পরিচয় ছাড়া জনৈক স্থানীয় ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, আমরা আজ গোপন সূত্রে খবর পাই, সোনাইমুড়ি বাজারে হাজী বিরানী হাইজের রান্না করা বিরানী থেকে পচা দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। তদন্তের জন্য দোকানে গিয়ে আমরা এর সত্যতা পাই। দোকান থেকে মূল কারখানায় গিয়ে দেখতে পাই, সেখানে ৭০ কেজি পচা কাচা মাংস রাখা আছে , যেটা ইন্ডিয়া থেকে বাজারজাত করা হয়ে থাকে গণ্ডা’র গোস্তো নামে ।
মূল ভিডিওতে স্থানীয় বাজার মালিক সমিতির যুগ্ম আহবায়ক মো: খলিলুর রহমান সহ কয়েকজন ইন্টারভিউ দেন। সবাই পচা মাংস দেওয়ার অভিযোগ করেন। এদের মধ্যে কেউই গন্ডার (Rhino) নামক আফ্রিকান প্রাণীর মাংসের কথা উল্লেখ করেননি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর বক্তব্য
ফ্যাক্টওয়াচ এর পক্ষ থেকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ফজলুর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান , এটা সম্পূর্ণ গুজব। হাজী বিরিয়ানী থেকে পচা মাংস উদ্ধার করা হয়েছে। পচা মাংস রাখার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আমি কখনোই কোনো সাংবাদিককে বা অন্য কোনো জায়গায় ‘গন্ডারের মাংস উদ্ধার’ এর কথা বলিনি। গন্ডার সংক্রান্ত গুজব টা কিভাবে ছড়াল, বুঝতে পারছি না।
অন্য সংবাদমাধ্যমে এই খবর
অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ‘গন্ডারের মাংস দিয়ে বিরিয়ানি বিক্রি’ হিসেবে এই খবরটা প্রকাশ করলেও আজকের পত্রিকাকে দেখা গিয়েছে ব্যতিক্রমী সংবাদ প্রচার করতে। তাদের খবরের শিরোনাম, বিরিয়ানির দোকান থেকে পচা মাংস ,গন্ডারের মাংস বলে অপপ্রচার।
সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ফজলুর রহমান আজকের পত্রিকার প্রতিবেদক কে বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে সোনাইমুড়ী কলেজ গেইট এলাকার হাজী বিরিয়ানিতে আমরা অভিযান চালাই। অভিযানকালে ওই প্রতিষ্ঠানের ফ্রিজ থেকে ৭০ কেজি কাঁচা ও ৩০ কেজি রান্না করা মাংস উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত মাংসগুলো পচা ছিল। এ প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন যাবত পচা গলা মাংস বিক্রি ও রান্না করে আসছিল অভিযোগ রয়েছে।
পচা মাংস উদ্ধারের পর ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্ধারকৃত মাংসগুলোকে গন্ডারের মাংস বলে বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে যা কারও কাম্য নয়। যারা এমন সংবাদ প্রকাশ করেছেন তাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার।
এছাড়া বাংলা ট্রিবিউন তাদের খবরের শিরোনাম করেছে, পচা মাংসের বিরিয়ানি বিক্রি, দোকান সিলগালা ।
খবরের মূল অংশে বলা হয়েছে- ফজলুর রহমান বলেন, সোনাইমুড়ী বাজারের হাজী বিরিয়ানি হাউস পচা মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে বিক্রি করছে—এমন খবরে অভিযান চালিয়ে ৩০ কেজি রান্না করা ও ৭০ কেজি পচা কাঁচা মাংস জব্দ করা হয়। তবে মাংসগুলো কীসের ছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মাংস নিয়ে অতীতের গুজব
বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই মাংস নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক শোনা যায়। ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোরায় গরু বা খাসীর বদলে কুকুরের মাংস দিয়ে বিরানী রান্না করা হয়, এমন গুজব শোনা যায় মাঝে মাঝে। ২০১৭ সালে ফ্যাক্টচেক ওয়েবসাইট যাচাই ডট কম এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে জানায় , ঢাকায় কুকুরের মাংস দিয়ে বিরিয়ানী রান্নার দাবিটি অপ্রমাণিত।
এরপরেও এমন গুজব বন্ধ হয়নি। ২০১৮ সালের পুরান ঢাকার নীরব হোটেলে ভাংচুর চালানো হয় কুকুরের মাংস দেওয়ার অভিযোগে।
২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জে কুকুরের মাংস সরবরাহের সন্দেহে ২ জন হোটেল কর্মচারী স্থানীয়দের হাতে গনপিটুনির শিকার হন। পরে জানা যায়, কুকুর নয়, মহিষের মাংস ছিল সেটি।
এছাড়া, অজগরের মাংস চট্টগ্রামের হোটেলে বিক্রির আরেকটি গুজব পাওয়া যায় ২০১৭ সালে। যাচাই ডট কমের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই দাবি অপ্রমাণিত।
গন্ডারের মাংসের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে কখনো কোনো গন্ডারের অস্তিত্ত্বের কথা শোনা যায়নি। ভারতের পূর্বাঞ্চলে কিছু গন্ডার রয়েছে বলে জানা যায়। আইনত এসব গন্ডার শিকার করা নিষিদ্ধ। তবে গন্ডারের শিং এর লোভে কিছু চোরাশিকারী লুকিয়ে লুকিয়ে গন্ডার শিকার করে। আসাম বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে , ২০১৬ সালে এমন ২০ টি গন্ডার শিকার এর তথ্য পাওয়া গেছে।
দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাটি এমন বেশি নয়, যে বিপুল পরিমান পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এই গন্ডারের মাংস বাংলাদেশে লাভজনক দামে বিক্রি করা যাবে।
আসাম কিংবা ভারতেও কখনো গন্ডার এর মাংস বিক্রির কথা শোনা যায়নি।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে হাজী বিরিয়ানি হাউজে পচা দুর্গন্ধযুক্ত মাংস উদ্ধার হয়েছে ঠিকই, তবে এটি গন্ডারের মাংস নয়। ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান। |