বাংলাদেশের সেনাপ্রধান মিয়ানমারকে কোন যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দেন নি

Published on: September 27, 2022

“মিয়ানমারকে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি সেনা-প্রধানের’’- শিরোনামে একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে দাবি করা হয়েছে, গত ২১শে সেপ্টেম্বর রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যের মাঝে সেনা প্রধান মিয়ানমারকে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তবে ফ্যাক্টওয়াচ সেনাপ্রধান এর উক্ত বক্তব্য বিশ্লেষণ করে সেখানে কোনো যুদ্ধের হুঁশিয়ারি পায়নি। ফেসবুকের বাইরে কোনো সংবাদমাধ্যমও একে ‘যুদ্ধের হুঁশিয়ারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। এছাড়া ২১শে সেপ্টেম্বর ছাড়া অন্য কোনো সময়েও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের কোনো বক্তব্যে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি পাওয়া যায়নি।


গুজবের উৎস

গত ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে World Defence Update BD নামক একটি পেজ থেকে একটি ভিডিও আপলোড করা হয়। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা হয় “মিয়ানমারকে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি সেনা-প্রধানের। প্রস্তুত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।” পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপে এই ভিডিওটি দেখা যায় । এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে






কি বলা হচ্ছে এই ভিডিওতে ?

ভিডিওটির অডিওতে ভাষ্যকার বলতে থাকেন , “বাংলাদেশ সীমান্তে একমাসের বেশি সময় ধরে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিষয়ে কোন ধরনের মন্তব্য করেনি। গতকাল ২১শে সেপ্টেম্বর মিয়ানমারকে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ। তিনি তার বক্তব্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান তুলে ধরেন।

মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রথম থেকেই সতর্ক অবস্থানে ছিল। তবে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের দায়িত্ব সীমান্ত অঞ্চলে সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সীমান্ত অঞ্চলে অতিরিক্ত বর্ডার গার্ড মোতায়েন করেছে স্বরাষ্ট্র দপ্তর। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ সময়ের মাঝে যুদ্ধের জন্য যা যা দরকার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে সেনাবাহিনী। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনী প্রধান। অর্থাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কোনো ধরনের হুমকি না দিলেও গোপনে প্রস্তুতি নিয়েছে। যদিও বিষয়টি অনুমেয় ছিল । কারন,  মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের দুইটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। প্রায় ১০-১২ হাজার সৈনিক সেখানে মোতায়েন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

মিয়ানমার সীমান্তে মোতায়েন সকল সৈনিকের ছুটি বাতিল করেছে বাংলাদেশ। বিষয়টি প্রমাণ করে বাংলাদেশ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুৎ ছিল। তবে সেনাবাহিনীর অবস্থান থেকে আরো শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জানিয়েছে সকল ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহ করতে দীর্ঘমেয়াদী সময় প্রয়োজন। কার মিয়ানমার সীমান্তে অতিরিক্ত সমরাস্ত্র মোতায়েন করতে হবে। বাংলাদেশের রামু সেনাঘাঁটি এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক। কার মিয়ানমার সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে এই ঘাঁটির অবস্থান। ——–

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সকল প্রস্তুতি গ্রহণের পর  প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন সেনাবাহিনী প্রধান। কার সামরিক শাখার প্রধান প্রধানমন্ত্রী নিজেই। তাই তার অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধ ঘোষণা করা সম্ভব নয়। কিংবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে না। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করেন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে হুঁশিয়ারি দিতে চাই। কার সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অবস্থান মেনে নেওয়া কঠি। পরবর্তীতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এবং মিয়ানমারকে শক্তিশালী বার্তা দেয়। কোনো ধরনের উস্কানির প্রমাণ পেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রস্তুত আছে।

মিয়ানমার এক্ষেত্রে নীরব ছিল। তবে দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা হামলা করেনি। বরং বিদ্রোহী গোষ্ঠি হামলা চালিয়েছে। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কার কখনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালন করতে পারেনি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অতীতে  তারা অনেকবার বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে হামলা চালিয়েছে। ——–

বাংলাদেশের ভূ-খন্ড রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের  হুঁশিয়ারি  গুরুত্বপূর্ণ। তবে এক মাস পরে এই ধরনের বার্তা দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে হামলার প্রথম দিনই হুঁশিয়ারি দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে পরবর্তীতে ৩ বার হামলার সাহস পেত না। তবে সেনাবাহিনী হয়ত চেয়েছিল প্রথম দিনেই হুঁশিয়ারি দিতে। তবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পায়নি। কারন সেনাবাহিনী প্রধান উল্লেখ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট তিনি অনুমতি চেয়েছিলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে একটি যুদ্ধের বার্তা দিতে। তবে প্রধানমন্ত্রী হয়ত বা যুদ্ধের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না । তাই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরেও সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সুরক্ষায় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রসংশনীয়। সেনাবাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর সকল সদস্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব বিশ্বমানের তা অসংখ্যবার প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দক্ষতা বাংলাদেশের ধারেকাছেও থাকবে না ।

অর্থাৎ , দেখা যাচ্ছে কেবলমাত্র ভিডিওর ক্যাপশনে যুদ্ধের হুঁশিয়ারির কথা এবং ভিডিওর ইন্ট্রোতে গতকাল ২১শে সেপ্টেম্বর মিয়ানমারকে যুদ্ধের হুশিয়ারি দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ  –মর্মে জানানো হলেও পুরো ভিডিওতে এই হুঁশিয়ারি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এছাড়া, দীর্ঘ এই ভিডিওতে পুরা সময়েই ভাষ্যকার তার ভাষ্য বলে গিয়েছেন। সেনাবাহিনী প্রধান এর বক্তব্যের কোনো ক্লিপ এখানে ব্যবহার করা হয়নি।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

সেনাবাহিনী প্রধানের ২১শে সেপ্টেম্বরের বক্তব্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল, সেদিন ঢাকা সেনানিবাসস্থ সেনা মালঞ্চে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস-২০২২ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত ‘বিশ্ব শান্তিতে বাংলাদেশের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে সেনাবাহিনী প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি   ‘বিশ্ব শান্তি  প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা’ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন।

বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম সময় টিভি ২১ শে সেপ্টেম্বর,২০২২ তারিখে ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদের সেদিনের বক্তব্য পাওয়া যায়। সেখানে তিনি ইংরেজিতে তার বক্তব্য দিলেও সময় টিভি সাবটাইটেলে তার বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছে।

এই বক্তব্যের এক পর্যায়ে মিয়ানমার প্রসঙ্গে জেনারেল  শফিউদ্দিন বলেন -”সীমান্তে মিয়ানমারের সঙ্গে উত্তেজনায় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়োজিত আছে। সব ধরনের ব্যবস্থা এরই মধ্যে সম্পন্ন করা আছে। প্রয়োজন অনুযায়ী যখন যা করতে হবে, তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী। সে লক্ষ্যে সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। প্রধানমন্ত্রীকে সব হালনাগাদ তথ্য জানানো হচ্ছে। উগ্রবাদী একটি গোষ্ঠী সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কোনো অংশগ্রহণ নেই এখানে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সব পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রস্তুত আছে।”

দেখা যাচ্ছে, পুরোপুরিভাবে উক্ত বক্তব্যটি ছিল রক্ষণাত্মক এবং সেখানে আক্রমণাত্মক কোনো বাক্য ছিল না। ‘যুদ্ধ’ বা ‘যুদ্ধের হুঁশিয়ারি’ সম্পর্কিত কোনো কথাই এই বক্তব্যে ছিল না।

সময় টিভির ইউটিউবে প্রকাশিত জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য দেখুন এখানে

 

সময় টিভি ছাড়াও ২২শে সেপ্টেম্বর,২০২২ তারিখে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা , বণিক বার্তা ,  দৈনিক শিক্ষা সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সেনাবাহিনী প্রধান-এর এই বক্তব্য প্রচার করেছে। কোনো সংবাদ মাধ্যমই ‘যুদ্ধের হুঁশিয়ারি’র কোনো কথা ছাপায়নি।

 

উল্লেখ্য, দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে বাংলাদেশের সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে ইকবাল নামে একজন নিহত এবং অন্তত ৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা শুরু হয়েছে।

দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদন দেখুন এখানে

২৫শে সেপ্টেম্বর ভিন্ন এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান আবারো বক্তব্য রাখেন। সেনাবাহিনীতে নতুন সামরিক বিমান সংযুক্তি উপলক্ষ্যে তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন এবং উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী দিক নির্দেশনা এবং বিশেষ আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। জাতির আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সকল সময়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা প্রস্তুত রয়েছে বলে তিনি তাঁর দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন।

দেখা যাচ্ছে, এই বক্তব্যেও তিনি কোনো ধরনের যুদ্ধির হুঁশিয়ারি দেননি।

নিকট অতীতে তার অন্য কোনো বক্তব্য পাবলিক ডোমেইনে পাওয়া যাচ্ছে না।

সারমর্ম

যেহেতু ভাইরাল ভিডিওর শিরোনাম এর সাথে মূল ভিডিওর মিল পাওয়া যায়নি, ভিডিওর সাথে অডিও ধারাভাষ্যের কোনো মিল পাওয়া যায় নি এবং শিরোনামে দাবি করা বক্তব্যের সাথে সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্যের মিল পাওয়া যায় নি  তাই ফ্যাক্টওয়াচ এ সংক্রান্ত  পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh