বাংলাদেশের বৈধ পর্যটকদের “অবৈধ বাংলাদেশী” নাম দিয়ে ভিডিও

Published on: June 1, 2022

ভারতের দিল্লির শাহীনবাগ এ প্রচুর বাংলাদেশী অবৈধভাবে বসবাস করছেন – এই মর্মে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।  মাইক্রোফোন হাতে এক ব্যক্তি শাহীনবাগের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এলাকাবাসীকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করছেন, তিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন কিনা, এবং স্থানীয়রাও হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিচ্ছেন- এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।  ভিডিওতে সাক্ষাৎকার দেওয়া সবাইকে “অবৈধ বাংলাদেশী” ধরে নিয়ে অনেকেই এই বিভিন্ন ক্যাপশন জুড়ে দিয়ে এই ভিডিও শেয়ার করছেন। তবে অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, তারা মূলত ভিসার কাজে বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে ভারতে গিয়েছেন এবং সাময়িকভাবে সেখানে অবস্থান করছেন ।

গুজবের উৎস

ভিডিওটি প্রথম আপলোড করা হয়েছিল ৭ই মে, দুপুর ১ টা  ২৩ মিনিটে Vartmaan Bharat নামের একটি পেইজ থেকে।

এই ভিডিওটি পরে ফেসবুকের আরো বিভিন্ন একাউন্ট, পেজ এবং গ্রুপ থেকে শেয়ার হতে দেখা যায়। যেমন দেখুন  এখানে , এখানে ,এখানে ।

বাংলা ভাষাতেও এই গুজবটি ছড়িয়ে পড়ে। যেমন –এখানে , এখানে , এখানে , এখানে   ।


এই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একজন রিপোর্টার নামাজ থেকে ফেরা মানুষকে প্রশ্ন করছে তারা কোন দেশের নাগরিক, জবাবে তারা বলছেন তারা বাংলাদেশি। ভিডিওতে হিন্দি ভাষায় লেখা দেখা যাচ্ছে “শাহীনবাগে বাংলাদেশিদের আড্ডাঃ উন্মোচন”

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে রিপোর্টার সবাইকে তাদের জাতীয়তা জিজ্ঞেস করছে, এবং যেহেতু বাংলাদেশিরা হিন্দি ভাষা বুঝতে পারছেন না, তারা তার প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারছেন না। এই সুযোগে রিপোর্টার বলার চেষ্টা করছেন দিল্লীর আম আদমি পার্টির সরকার অরবিন্দ কেজরিওয়াল কি তাদের শাহীনবাগে বাস করার জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ও পানি দিচ্ছেন কি না!

ভিডিওতে কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে বলতে যে তারা ভারতে এম্বেসির কাজে এসেছেন। কিন্তু রিপোর্টার তাদের সেই উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন ।

বরং ভিডিওটিতে রিপোর্টার বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞেস করছিল “ভারতে কীভাবে এসেছো? কাঁটাতার পার হয়ে না কি বিমানে?” এবং “পয়সা দিয়েছে?”

Vartmaan Bharat এসব মানুষকে শাহীনবাগে CAA বিরোধী প্রতিবাদে আসা “paid agent” হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে।

৮ই মে, ২০২২ তারিখে  দিল্লীর বিজেপি নেতা এবং ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি অশ্বিনী উপাধ্যায় তার ভেরিফাইড টুইটার এবং ফেসবুক পেইজে এই ভিডিও শেয়ার করেন ।

অশ্বিনী উপাধ্যায় টুইটে তার ক্যাপশনে লিখেন-

“রোহিঙ্গা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ১০০% সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং ১০-২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিতে আইন বানানো আব্যশক @narendramodi”

অশ্বিনী উপাধ্যায়ের টুইটার এবং ফেসবুকে দেওয়া ভিডিওটি প্রায় ২.৫ লক্ষ বার দেখা হয়েছে।

অশ্বিনী উপাধ্যায় ছাড়াও বিজেপির সদস্য মেজর (অবঃ) সুরেন্দ্র পুনিয়া টুইট করেন “রোহিঙ্গা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা দিল্লীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কেন শুধু দিল্লীতেই তারা আসে? কে তাদের রেশন কার্ড এবং ভোটার আইডি দেয়? কারা তাদের থাকার খরচ জোগায়?”

দিল্লী বিজেপির মুখপাত্র সারিকা এ জৈন-ও এই ভিডিও শেয়ার করেন, তিনি লিখেন:

এরা সবাই মুখ্যমন্ত্রীর (অরবিন্দ কেজরিওয়ালের) আত্মীয়। হিন্দু ভাইয়েরা দেখুন, কীভাবে আপনাদের দিল্লী আপনাদের হাত থেকে চলে যাবে।


অনুসন্ধান

ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকার AltNews এ বিষয়ে গত ১২ই মে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। FB page brands Bangladeshi tourists as “infiltrators”, BJP leaders amplify false claim শিরোনামের এই প্রতিবেদনে তারা Vartmaan Bharat এর ভিডিওতে দেখানো বাংলাদেশিদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। স্থানীয় সাংবাদিক আরবাব আলি’র মাধ্যমে তারা জানতে পারে এই ভিডিওটি করা হয়েছিল শাহীনবাগের মসজিদ আল-হাবিবের পাশে। নামাজ থেকে বের হয়ে আসা লোকদের এসব উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন করা হয়েছিল।

AltNews এর সাংবাদিকরা পাঁচজনকে খুঁজে বের করেছে যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল Vartmaan Bharat  সাংবাদিক আরবাব আলি । তাদের নাম আরিফ হোসাইন, ফাহাদ মাহফুজ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আখতার হোসাইন, এবং রাশিদ-উল হাসান। AltNews নিশ্চিত করেছে যে এই লোকদের অধিকাংশই দিল্লী এসেছিলেন মাল্টা এম্বেসিতে ভিসার কাজে।

AltNews এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে রাশিদ-উল হাসান বলেনঃ “বাংলাদেশে মাল্টা এম্বেসি নাই। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সরকারের সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশি মাল্টা অভিবাসন ইচ্ছুকদের জন্য ভারতে অবস্থিত মাল্টা এম্বেসি ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছে।“

তিনি আরোও জানান কমপক্ষে ৩৫০ জন বাংলাদেশি ভারতের এসেছেন ভিসার কাজে, এবং তারা দিল্লীর বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষত পাহাড়গঞ্জ এবং সরিতা বিহার এলাকার বিভিন্ন হোটেলে থাকেন।

আরিফ হোসেন নামের আরেক পর্যটক জানান , এই ভিডিওটা ভুয়া । সে আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, আমি কোথা থেকে এসেছি। আমি সেটাই উত্তর দিয়েছি। পুরা ভিডিওর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই বলেনি। বাংলাদেশী নাগরিক এবং পর্যটকদের জন্য এই ভিডিওটা খুব ক্ষতিকর হতে পারে।

ফাহাদ মাহফুজ চৌধুরী নামের আরেক পর্যটক ও একই কথা বলেন।

AltNews এর কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হোটেল কর্মচারি জানান এসব এলাকায় শুধু বাংলাদেশিই না, ইরাক, ইরান থেকেও লোক আসে…বাংলাদেশিরা বেশি আসে, এবং তাদের ভিসার কাজ শেষ হতে তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। যদি তাদের ভারতের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তারা আবার ভিসার জন্য Foreign Regional Registration Offices এর সাথে যোগাযোগ করেন।“

ফ্যাক্টওয়াচের পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশেও  একটি ভিসা প্রসেসিং  এজেন্সির কাছে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম।  তারা জানায়:

“Schengen-ভুক্ত দেশ (যেমন মাল্টা), বা ইউরোপের যে কোনো দেশের ভিসার জন্য  উক্ত দেশের এম্বেসি অথবা VSF-এ কাগজপত্র জমা দিতে হয়। সি ক্যাটাগরির ভিসা, বা স্বল্প মেয়াদের ভিসা পাওয়ার জন্য আগ্রহী প্রার্থীকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না সাধারণত। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের ভিসা, যেমন ওয়ার্ক পারমিট বা স্টুডেন্ট ভিসার জন্য এম্বেসিতে কাগজপত্র জমা দেয়ার পর ইন্টারভিউ এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বর্তমানে চাপ বেশি থাকায় এই ইন্টারভিউয়ের তারিখ পেতে দীর্ঘদিন সময় লাগতে পারে।

মাল্টা এম্বেসি ভারতে থাকায় বাংলাদেশ থেকে ভিসা প্রত্যাশীরা ভারতে গিয়ে তাদের কাগজপত্র জমা দেন। আসা যাওয়ার খরচ বিবেচনা করে অনেকেই সিদ্ধান্ত নেন ভারতে থাকার, যেন তারা সময়মত ইন্টারভিউতে উপস্থিত থাকতে পারেন। তারা আইনতই থাকেন, কারণ ভারতে তারা ভারতে অবস্থান করার ভিসা নিয়েই থাকেন। এই ভিসার মেয়াদ সাধারণত দুই মাসের হয়ে থাকে। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আবার তারা ফি দিয়ে ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে পারেন। অর্থাৎ, ভারত সরকারের পাওনা সকল ফি দিয়েই তারা ভারতে অবস্থান করেন। তাদের অনুপ্রবেশকারী বা রোহিঙ্গা বলার কোনো সুযোগ নেই।”

ভারতের ডানপন্থীদের মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতির একটি বড় হাতিয়ার হচ্ছে প্রতিপক্ষকে মুসলিম অথবা বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেয়া। এর আগে তারা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মুসলিম বংশোদ্ভূত ছিলেন বলে অপপ্রচার চালিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সময়ে তৃণমূলকে কোণঠাসা করতে তারা বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশের অপপ্রচার চালিয়েছিল।  আরোও দেখুন এখানে

এই বিষয় নিয়ে ২৭শে মে তারিখে বিবিসি বাংলা ভারতে বৈধ ভাবে যাওয়া বাংলাদেশিদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে দিল্লিতে শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালীর এই প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক জানিয়েছেন যে ”কাঁটাতারের বেড়ার নিচ দিয়ে না ওপর দিয়ে কীভাবে এসেছেন ভারতে?” – এই প্রশ্নে খুবই অপমানিত হয়েছেন তারা।

অল্ট নিউজ এর সাংবাদিক অর্চিতা মেহতা জানাচ্ছেন, “একটা বিষয় খেয়াল করবেন যে ভিডিওগুলো কিন্তু শুধুই ফেসবুকে দেওয়া হয়েছে। ইউটিউব বা টুইটারের মতো অন্য কোথাও নেই এটা। কারণটা স্পষ্ট – (হিন্দুত্ববাদী) ইকোসিস্টেমের সবথেকে বেশি ফলোয়ার ফেসবুকেই আছে। সব থেকে বেশিবার যাতে দেখা হয় আর শেয়ার হয়, সেজন্যই ফেসবুককে বেছে নেওয়া হয়েছে,” বলছিলেন অর্চিত মেহতা।

বিবিসি’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারতে হিন্দুত্ববাদী ইকো সিস্টেম যাকে বলা হচ্ছে, সেটি হল আরএসএস বিজেপি আর সংঘ-ঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলির অগণিত অনুগামী – যাদের মাধ্যমে যে কোনও খবর বা ছবিকে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল করে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ সময়েই অপ্রাসঙ্গিক কোনও ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেয় এই হিন্দুত্ববাদী ইকোসিস্টেম।

সারমর্ম

ভাইরাল এই ভিডিওতে মোট ৩ টি দাবি উত্থাপন করতে দেখা যায়।

১. শাহীনবাগে অনেক অবৈধ বাংলাদেশী থাকেন ( হ্যা, অনেক বাংলাদেশী থাকেন কিন্তু তারা বৈধভাবে এসেছেন)
২. শাহীনভাগে অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম থাকেন  (ইন্টারভিউতে একজনও বলেন নি যে তারা রোহিঙ্গা বা মায়ানমার থেকে এসেছেন)
৩. আম আদমি সরকারের আনুকূল্যে তারা বিনা খরচে থাকছেন ( এই অভিযোগ নাকচ করেছেন সাক্ষাৎকারদাতা ব্যক্তিরা)

কাজেই,  এটা প্রমাণিত হয় যে , প্রধানত বিজেপি নেতা ও মুখপাত্রদের দাবি যে বাংলাদেশি-রোহিঙ্গারা দিল্লীতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকারের আশ্রয়ে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ীভাবে বাস করছে- এই দাবিটি সম্পূর্ণ অসত্য, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ভিডিওতে দেখানো বাংলাদেশিরা ভারতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের এম্বেসিতে ভিসার কাজে গিয়েছেন, এবং সম্পূর্ণ আইনত সেখানে সাময়িকভাবে থাকছেন তাদের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। ফ্যাক্টওয়াচ এই ভিডিওকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply