আল-জাজিরা কি বিপিএল ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং এর প্রমাণ পেয়েছে?

Published on: February 18, 2022

‘’ব্রেকিং নিউজঃ বিপিএলে ফ্লেচারের বিরুদ্ধে স্পট ফিক্সিংয়ের সন্দেহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার’’-একটি অনলাইন পোর্টালের বরাতে এমন একটি খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা চ্যানেল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ক্রিকেট এ ম্যাচ ফিক্সিং সম্পর্কিত কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

গুজবের উৎস

Kheladhulareport.com নামক একটি অনলাইন পোর্টালে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল । এই সংবাদের শিরোনাম ছিল- ব্রেকিং নিউজঃ বিপিএলে ফ্লেচারের বিরুদ্ধে স্পট ফিক্সিংয়ের সন্দেহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার ।

এই খবরের লিংক অনেকে শেয়ারের মাধ্যমে ফেসবুকে খবরটি ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে  ।

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

এই খবরে বলা হয়েছে,

গতকাল খুলনা টাইগার্সের ওপেনার আন্দ্রে ফ্লেচার ৫৮ বলে অপরাজিত ৮০ রানের ইনিংস খেলেও দলকে কোয়ালিফায়ারে নিতে পারেননি। হাফ সেঞ্চুরির এই ইনিংসে তার স্ট্রাইকরেট ছিল মাত্র ১২৫; শেষ ১২ ওভারে তিনি হাঁকান মাত্র ৩টি বাউন্ডারি।

দলের প্রয়োজনের সময় আগ্রাসী ছিল না এই ক্যারিবিয়ানের ব্যাট। সব মিলে ম্যাচের গতিপথ ও তার ব্যাটিংয়ের ধরন দেখে দানা বাঁধছে স্পট ফিক্সিংয়ের সন্দেহ।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার ক্রিকেট ম্যাচ ফিক্সার ডকুমেন্ট্রির স্টিং অপারেশনে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ও ঘরোয়া ক্রিকেটে তা সম্ভব। ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগগুলো ঘিরে দেখা মেলে নানা প্রশ্ন আর সন্দেহ।

তেমনই বিপিএলের এলিমিনেটর ম্যাচ ঘিরে উঁকি দিচ্ছে কিছু প্রশ্ন। ৪১০ রান নিয়ে চলতি আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক খুলনার ওপেনার আন্দ্রে ফ্লেচার বলেছিলেন, আমি ছেলেদের বলেছিলাম, ফাইনাল খেলা ছাড়া এখান থেকে যাবো না।আমাদের লক্ষ্য এখনও পূরণ হয়নি। এখনও উদযাপনের সময় আসেনি। আমাদের ফাইনাল খেলতে হবে। ভালো খেলার সুযোগ আছে। অথচ এলিমিনেটরে চট্টগ্রামের কাছে ৭ রানের হারে আসর থেকে বিদায় নিতে হয় খুলনা টাইগার্সকে।

প্লে অফ নিশ্চিতে কুমিল্লার বিপক্ষে ম্যাচে রেকর্ড জুটি গড়ার পাশাপাশি আন্দ্রে ফ্লেচার অপরাজিত ছিলেন ১০১ রানে। শক্তি সামর্থ্য়ের দিক দিয়ে ৩৪ বছর বয়সী এই ক্যারিবীয়কে নিয়ে নেই কোনো প্রশ্ন। বলেছিলেন, ফাইনাল না খেলে বাংলাদেশ ছাড়বেন না।

তবে এলিমিনিটরে চট্টগ্রামের বিপক্ষে মেলানো যায়নি অনেক হিসেব। ১৯০ রানের লক্ষ্যে ওপেনিংয়ে নেমে শুরু থেকেই বিধ্বংসী ছিলেন ফ্লেচার। ইনিংসের ৪র্থ বলেই নাসুমকে ছক্কা হাঁকান তিনি।

পাওয়ার প্লেতে ২৫ বল থেকে তোলেন ৪০ রান। এরপরেই ঘটে ছন্দপতন। পরের ১০ রান করতে তিনি খেলেন ৯ বল। সে সময় অবশ্য উইকেটে সাবলীল ছিলেন মুশফিক।

অষ্টম ওভারে বাউন্ডারি মারার পরের ৩৮ বলে ফ্লেচারের ব্যাট থেকে আসেনি চার কিংবা ছয়। তবে ১৫, ১৭ আর সব শেষ ওভারে একটি করে বাউন্ডারি মারেন তিনি, যা প্রয়োজনের নিরিখে যথেষ্ট ছিল না।

যদিও এ সময়ে ইয়াসির রাব্বি ছিলেন দুর্দান্ত। ৩৪ বলে চার ছক্কার ফুলঝুরিতে ফ্লেচার করেন ফিফটি। ১৪৭ এর উপর ছিল তার স্ট্রাইক রেট। পরের ৩০ রান আসে ২৪ বলে। স্ট্রাইক রেট অনেকটা নেমে আসে ১৩৭ এ।

পাওয়ার প্লের পর ২১টি সিঙ্গেল আর ৬টি ডট বল খেলেন ফ্লেচার। অর্থাৎ, ফিফটির পর ধীরগতির ব্যাটিং ছিল ফ্লেচারের। শেষ পর্যন্ত ৫৮ বলে তার ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ৮০ রান।

শেষ ৩ ওভারে যখন জয়ের জন্য যখন দরকার ছিল ৪২ রান, তখন ফ্লেচারের ব্যাট থেকে আসে মাত্র ১টি বাউন্ডারি। এসব কারণেই, ৮০ রানের ইনিংস খেলেও যেন আতশ কাঁচের নিচেই আছেন আন্দ্রে ফ্লেচার।

দেখা যাচ্ছে, সম্পূর্ণ খবরে কোথাও বলা হয়নি যে ,আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এই ম্যাচটি ফলো করেছে কিংবা এই ম্যাচ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেছে। কিন্তু শিরোনামে আল-জাজিরার নাম ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা দেখে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন।

২০১৮ সালে আল জাজিরার চালানো একটি স্টিং অপারেশনের  প্রসঙ্গ এসেছে আলোচ্য প্রতিবেদনের এক পর্যায়ে। আল জাজিরার উক্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেস্ট ক্রিকেটাররা স্পট ফিক্সিং এ জড়িত, এবং বাজিকরদের চাহিদা অনুযায়ী ম্যাচের নির্দিষ্ট সময়ে ভাল কিংবা খারাপ খেলতে পারেন কিংবা নির্দিষ্ট কাজ করতে পারেন।

আল জাজিরার এই প্রতিবেদনের পর বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ড এবং আইসিসি তদন্ত শুরু করে। ২০২১ সালের মে মাসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল তাদের তদন্তের ইতি টেনে জানায়, আল জাজিরার প্রতিবেদনের সত্যতা খুজে পাওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডসহ অন্যান্য বোর্ডও এই প্রতিবেদনের সত্যতা না পাওয়ার কথা জানায়।

আল জাজিরার ওয়েবসাইট থেকে দেখা গেল, তারা নিয়মিতভাবে বিপিএল কভার করে না। বরং বিপিএল এ কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলে সেটাই তাদের ওয়েবসাইটে জায়গা পায়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের পর বিপিএল সম্পর্কিত কোনো খবর তাদের ওয়েবসাইটে নেই।

বিপিএল-২০২২ এর এলিমিনেটর ম্যাচে আন্দ্রে ফ্লেচার এর ইনিংস নিয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য বেশ কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে এসব প্রতিবেদনে কেউই আল জাজিরার নাম ব্যবহার করেনি, বরং ক্রীড়া প্রতিবেদকরা তাদের নিজেদের সন্দেহের কথাই জানিয়েছেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে,  বিপিএল এর দ্বিতীয় আসরে (২০১৩ সাল) মোহাম্মদ আশরাফুল সহ বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে  ম্যাচ ফিক্সিং এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনো টিভি চ্যানেল নয় ,বরং আইসিসির দুর্নিতি বিরোধী কমিশন (ACSU)এই প্রমাণ খুজে পেয়েছিল। অভিযুক্ত ক্রিকেটারদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় তখন।

চলতি বিপিএল-এর বিভিন্ন ম্যাচ দেখেও অনেক অভিজ্ঞ ক্রীড়ামোদী ফিক্সিং এর সন্দেহ করছেন। তবে আল জাজিরা কিংবা কোনো গণমাধ্যম এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।

সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই খবরটিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply