কার্বলিক এসিড দিয়ে কি সাপ তাড়ানো যায়?

Published on: June 24, 2022

বন্যার সময় বাসাবাড়িতে সম্ভাব্য সাপের উপদ্রব ঠেকাতে কার্বলিক এসিড সহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের একটি পরামর্শ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে নাম দিয়ে এই বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে,কার্বলিক এসিড বা এই জাতীয় কোনো পদার্থই সাপ তাড়াতে সাহায্য করে না। এছাড়া , জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই ধরনের কোনো বিজ্ঞপ্তি বা পরামর্শও খুজে পাওয়া যায়নি।

গুজবের উৎস

১৭ই জুন মধ্যরাতের পর থেকে ফেসবুকে এই গুজবটা ভাইরাল হতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়  এই পোস্টে বলেন –

জনসচেতনতামূলক পোস্ট !

বন্যা ও বর্ষাতে চারিদিক পানির কারণে সাপ ঘরে আশ্রয় নিতে পারে…

বন্যা কবলিত এলাকায় বিষাক্ত সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে শয়ন কক্ষে অথবা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে  কার্বক্সালিক এসিড/কার্বনিল এসিড অথবা কার্বলিক এসিডের ছিপি খুলে ঘরের কোনে রাখতে হবে।

 কার্বলিক এসিড পাওয়া না গেলে রসুন কেটে টুকরো টুকরো করে ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে ঘরে সাপ ঢুকবে না। অথবা ঘরে সাপ থাকলে বেরিয়ে যাবে।

© প্রচারে: জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এর বার্তা হিসেবে প্রচার করা হলেও এই ফেসবুকে এই বার্তার বেশ ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন- বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন এই পোস্টে কার্বলিক এসিড এবং রসুন ছাড়াও লাইফবয় সাবান, সজিনা এবং শুকনো মরিচ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এই একই পোস্ট আরো দেখতে পাবেন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধান

এই সকল ভাইরাল পোস্টের কমেন্ট বক্সেই অনেক সচেতন ফেসবুক ব্যবহারকারীই জানিয়েছেন, কার্বলিক এসিড কিংবা লাইফবয় সাবান দিয়ে সাপ তাড়ানো যায় না। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। এ ধরনের কয়েকটি কমেন্ট দেখুন এখানে-

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানেও দেখা যাচ্ছে, কার্বলিক এসিড সম্পর্কে এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে সাপ তাড়ানোর এমন বিশ্বাস থাকলেও এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।

উল্লেখ্য, কার্বলিক এসিড এর রাসায়নিক নাম Phenol । সংকেত C6H6O । এটি জীবানুনাশক হিসেবে বেশ কার্যকর । তবে ত্বকে অধিক পরিমাণে কার্বলিক এসিড লাগলে ত্বক পুড়ে যায় । মানুষ, সাপ কিংবা যেকোনো প্রাণীর ত্বকের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।

সাপ তাড়ানোর জন্য ঘরে কার্বলিক এসিড রাখলে দুর্ঘটনাক্রমে সেই এসিড শিশুদের শরীরে লেগে মারাত্মক বার্ন সৃষ্টি করতে পারে। ভারতের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রভাস প্রসূন গিরি ২০১৫ সালে মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে কার্বলিক এসিডের ক্রিয়ায় আক্রান্ত ৪ টি রোগী পেয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি দেখতে পাবেন এখানে

অন্যদিকে ,সাপ তাড়াতে কার্বনিল এসিড ব্যবহার এর কথা বললেও বাস্তবে ‘কার্বনিল এসিড’ নামে কোনো এসিডই নাই।

কার্বন এবং অক্সিজেনের দ্বিবন্ধনযুক্ত মূলককে (C=O) কার্বনিল মূলক বলে (Carbonyl group)। অন্যান্য বিভিন্ন যৌগের মধ্যে এই কার্বনিল গ্রুপ দেখা যায়। যেমন এ্যালডিহাইড, কিটোন, এ্যামাইড ইত্যাদি।

এই কার্বনিল মূলক (C=O) এর সাথে হাইড্রক্সি মূলক (-OH) যুক্ত হলে কার্বক্সি মূলক (-COOH) গঠিত হয়। যে এসিডে কার্বক্সি মূলক থাকে, তাকেই কার্বক্সিলিক এসিড বলে । অর্থাৎ, কার্বক্সিলিক এসিড নির্দিষ্ট কোনো এসিড নয় , বরং অনেকগুলো জৈব এসিডের একটি সাধারণ নামই হল কার্বক্সিলিক এসিড।

ফরমিক এসিড (HCOOH), ইথানয়িক এসিড (CH3COOH) ইত্যাদি হল কয়েকটি সাধারন কার্বক্সিলিক এসিড। এরা খুব দুর্বল জৈব এসিড। সাপ তাড়াতে কোনো কার্বক্সিলিক এসিডের ব্যবহার সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।

কার্বলিক এসিড কি সাপ তাড়াতে পারে ?

প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাস  কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন,

বাড়িঘরে সাপের আনাগোনা থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষ বাজার থেকে কার্বলিক অ্যাসিড কিনে এনে বাড়ির চারপাশে ছিঁটিয়ে রাখছে। অনেকের ধারণা অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধ সাপ সহ্য করতে পারে না। সে কারণে যে বাড়িতে কার্বনিক অ্যাসিড থাকে সেখানে সাপ আসে না। আসলে ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল।

কার্বলিক অ্যাসিড সাপের উপরের কোন প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করতে পারে না। এ ধরনের গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাপের কাছে কার্বলিক অ্যাসিডের বোতল রেখে দিলে দেখা যায় যে সাপ ওই বোতল পেঁচিয়ে বসে আছে। কার্বলিক অ্যাসিডের গন্ধে সাপের কিছুই যায় আসে না।


সিলেটের বন্যার পর অতি সম্প্রতি জাগো নিউজ এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে সরীসৃপ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ আদনান আজাদ আসিফ ও একই কথা বলেছেন। তিনি জানান,

ফেসবুকে অনেককে আমরা দেখছি যে বাসস্থানে লাইফবয় সাবান কেটে রাখা, মরিচপোড়া বা কার্বলিক অ্যাসিড রাখলে সাপ আসবে না বলে প্রচার করছেন। এগুলো কোনো কাজে আসবে না। এটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বিজ্ঞানে এর কোনো ভিত্তি নেই। মশারি টাঙানোটাই একমাত্র পদ্ধতি। মরিচপোড়াসহ এগুলো সব ফেক। এভাবে কখনো সাপ তাড়ানো যায় না। ফেসবুকে মানুষ এসব দিচ্ছে এবং মারাত্মক আকারে এগুলো শেয়ার করছে। এজন্য মানুষ ভুল জিনিসগুলো জানছে। এগুলো ফলো করতে গেলে মানুষ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।


ফেসবুকে দীর্ঘদিন ধরে সাপ এবং বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছে Deep Ecology And Snake Rescue Foundation নামক একটি গ্রুপ। এই গ্রুপ থেকেও জানা গেল , কার্বলিক এসিড সাপ তাড়াতে পারে না।

লাইফবয় সাবানে কি কার্বলিক এসিড রয়েছে?

ইউনিলিভার এর ওয়েবসাইটে লাইফবয় সাবানের উপাদান সমূহের তালিকায় কার্বলিক এসিড, কার্বনিল এসিড কিংবা কার্বক্সিলিক এসিড , কোনোটাই পাওয়া গেল না।

যেহেতু কার্বলিক এসিড ত্বকে লাগলেই সেটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, এবং লাইফবয় হাত ধোয়া সাবান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়, তাই লাইফবয় সাবানে এই ধরনের এসিড ব্যবহার করা অযৌক্তিক ।

বাংলাদেশ সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কি সাপ সম্পর্কিত এই বার্তাটি দিয়েছে ?

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এ ধরনের কোনো পরামর্শ, নোটিশ বা প্রেস রিলিস পাওয়া যায়নি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি আনভেরিফাইড ফেসবুক পেজ খুঁজে পাওয়া গেলেও সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো পোস্ট নেই।

ফেসবুকের বাইরে কোনো সংবাদমাধ্যমেও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বরাতে এই বিষয়ে কোনো সংবাদ বা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়নি।

সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল হওয়া এই পোস্টগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply