তুরস্কে উদ্ধারকাজে এসে চীনা নাগরিক ইসলাম গ্রহণ করেন নি

Published on: February 24, 2023

তুরস্কে ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজের সময় একজন চীনা উদ্ধারকর্মী কোরআন শরীফের একটি কপি উদ্ধার করেছেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন- এমন একটি খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তুরস্কের গণমাধ্যম ,আনাতোলিয়া এজেন্সির বরাতে জানা যাচ্ছে, উক্ত উদ্ধারকর্মী আগে থেকেই মুসলমান ছিলেন। তুরস্কে এসে নতুন করে ইসলাম গ্রহণ করেন নি।

গুজবের উৎস

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে


এছাড়া জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব এবং অনলাইন পত্রিকা আজকের বাংলাদেশেও এই সংবাদটি দেখা যায় ।

দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে,  তুরস্কে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ভবনের নিচে কুরআন খুঁজে পেয়েছেন এক চীনা উদ্ধারকর্মী। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশটির মালটিয়া প্রদেশে উদ্ধারকাজের সময় কুরআনটি পাওয়া যায়। স্থানীয় গণমাধ্যম এ তথ্য নিশ্চিত করে।

ওই চীনা উদ্ধারকর্মীর নাম জন সাং। তিনি তুরস্কে পাঠানো চীনা উদ্ধারকর্মী দল ইয়াকুতের অন্যতম সদস্য।

সাংয়ের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা তারই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী অ্যাডেম ডেমিরকিরান বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, সাং উদ্ধারের সময় কুরআন দেখে খুব অবাক হন। তিনি বলেন, তাদের বাড়িতেও এ কিতাব আছে। পরে তিনি কুরআনটি মালাতিয়া ইউসুভিলি পৌরসভা কাউন্সিলের সদস্য সিনান চাকমাজের কাছে অর্পণ করেন। এ সময় দোভাষীর সাহায্যে তিনি সিনানের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলেন। পরে নিশ্চিত হন, তার মা-বাবাও মুসলমান ছিলেন। তখন তিনিও মুসলিম হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চান, মা-বাবার ধর্মেই পরকালে তাদের সাথে মিলিত হতে।

উল্লেখ্য, জন সাং ইসলাম গ্রহণের পর তাকে ওই উদ্ধার করা কুরআন উপহার দেয়া হয়।

সূত্র : আল জাজিরা, খিদমত সনদ ও অন্যান্য



ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

ইনকিলাবে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, জনাব জন সাং এর বাবা মা দুজনেই মুসলমান ছিলেন । সেক্ষেত্রে জন সাং কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন, এটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। মুসলমান পিতামাতার সন্তান হিসেবে জন্মগতভাবে তার মুসলমানই হওয়ার কথা।  ইনকিলাবের প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত কোন তথ্য দেয়া হয়নি।

ইনকিলাবে তথ্যসূত্র হিসেবে আল জাজিরা ও খিদমত সনদ  এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আল জাজিরার মূল ইংরেজি ওয়েবসাইটে এমন কোনো খবর পাওয়া না গেলেও আল জাজিরা প্যালেস্টাইন নামক ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে সংক্ষিপ্ত আকারে এই খবরটি পাওয়া যায়।

ইনকিলাবে বর্ণিত খিদমত সনদ নামে সংবাদমাধ্যম ফ্যাক্টওয়াচ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে ।

চীনা উদ্ধারকর্মীর এই বিশেষ খবরটি আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে খুজে পাওয়া না গেলেও তুরস্কের কিছু গণমাধ্যমে এই খবরটি দেখা যাচ্ছে। যেমন , এখানে , এখানে , এখানে  , এখানে

তুরস্কের কিছু গণমাধ্যম আবার প্রকাশিত ছবি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে। তারা সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে গুজব হিসেবে উল্লেখ করেছে। যেমন – এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

গেরকেক নিউজ এর এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, তুরস্কের সরকার নিয়ন্ত্রিত কিছু গণমাধ্যমে একজন চীনা উদ্ধারকর্মীর কোরান শরীফ উদ্ধার এবং ইসলাম গ্রহণের গুজব প্রকাশিত হয়েছে। এখানে যে ছবি ছাপা হয়েছে সেটা ভালভাবে লক্ষ্য করলে যে কেউই বুঝতে পারবেন যে এসব ছবি আর্টফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে ।

kronos36 এর এই খবরে বলা হয়েছে , তুরস্ক যখন ভূমিকম্পের আঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে , গুজবের বিস্তার তখনো থেমে নেই। এবার চীনা এক উদ্ধারকর্মীর ইসলাম গ্রহণের গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।–দাবি করা হচ্ছে, এই উদ্ধারকর্মী ,জুন চাং (Jun Chang),  মিউনিসিপাল টিমের সাথে ইউসুফেলি শহরে যান। সেখানে ধ্বংসস্তুপের নিচে তিনি একটি কোরান শরীফ পান। তিনি এই কোরানটি Sinan Kaçmaz কে হস্তান্তর করেন, যিনি পুনরায় তাকে এটি উপহার হিসেবে প্রদান করেন। এ ঘটনায় মুগ্ধ হয়ে জুন চাং ইসলাম গ্রহণ করেন।

তুর্কিয়ে গেজেটেসি এর এই খবরে একজন স্থানীয় লোকের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে । পত্রিকায় বলা হয়েছে, মেহমেত নামের একজন ভূমিকম্প দুর্গত নাগরিক, যিনি বুখারা মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন, (যে মসজিদটি ভূমিকম্প দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে) বলেছেন, জুন চাং নামের চীনা ব্যক্তি ,একজন AFAD অফিসার এর সাথে আমাদের মসজিদে আসেন। তিনি জানান, তিনি একজন মুসলিম ছিলেন, এবং একটি কোরআন শরীফ চান। আমাদের মসজিদের ইমাম , ওমর বে ,তাকে একটি কোরআন শরীফ উপহার দেন। এরপর জউন চাং মসজিদের চারপাশে কিছুক্ষণ ঘুরে মসজিদ ত্যাগ করেন। পরদিন, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, একজন গাইড সহ ৪/৫ জন চীনা কর্মকর্তা (জুন চাং সহ) পুনরায় মসজিদে আসেন। তারা জানায়, তারা সবাই মুসলিম ছিলেন এবং আমাদের মসজিদে সাহায্য করতে চান। এরপর তারা কিছু অর্থ সহায়তা প্রদান করেন।

তুরস্কের সরকারী সংস্থা Directorate of Communications থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখের ডিসইনফরমেশন বুলেটিন এ এই চীনা উদ্ধারকর্মীর খবরটি আলোচিত হয়েছে। এই বুলেটিনে বলা হয়েছে, মিস্টার জুন চাং চীন থেকে উদ্ধার অভিযানের জন্য তুরস্কে এসে পৌছেছেন। কিছু কিছু গণমাধ্যম দাবি করছে, তার মসজিদে যাওয়া এবং কোরয়ান শরীফের সাথে তোলা ছবিগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। তবে   Yeşilyurt জেলার কর্মকর্তাদের দ্বারা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে এই চীনা নাগরিক প্রকৃতপক্ষেই ওই মসজিদ ভ্রমণ করেছিলেন এবং কোরান হাতে ছবি তুলেছিলেন। মিডল ইস্ট টেকনিকাল ইউনিভার্সিটির এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ Cihangir Tezca এই ছবিগুলো বিশ্লেষণ করেছেন এবং একে আসল ছবি বলে মত দিয়েছেন।

তবে এই ডিসইনফরমেশন বুলেটিনে জুন চাং এর ইসলাম গ্রহণ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আলোচনা করা হয়নি।

আনাতোলিয়া এজেন্সি এর এই খবরে প্রতিবেদক জুন চাং এর মন্তব্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন । জুন চাং জানিয়েছেন, ‘’চীনে আমি মুসলিম ছিলাম ( এবং তুরস্কে এসে আমি মুসলিম হইনি) , আমার পরিবার ও মুসলিম । আমি (আবর্জনা থেকে) কোরান বের করেছি । যে কারণে আমি ছবি তুলেছি – তার পেছনে আছে আমার নানী ( তুর্কী- Anneannem ), যার বয়স ৮০ বছর। তার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হল ক্বাবা শরীফ এবং বিভিন্ন মসজিদ ভ্রমণ করা । তবে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি সেটা করতে পারেন না। এখানে (তুরস্কে, আমার দেখা), প্রতিটি মসজিদেই আমি ছবি তুলছি এবং নানীকে পাঠাচ্ছি । তাকে সম্মান জানানোর জন্যই আমি এভাবে ছবি তুলছি“।

উল্লেখ্য, গত ৮ই ফেব্রুয়ারি চীনা উদ্ধারকারী দল তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় উদ্ধারকাজের জন্য যায়, এবং ১৭ই ফেব্রুয়ারি তারা তুরস্ক থেকে চীনে ফিরে যায়।

সার্বিক বিবেচনায়, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া চীনা উদ্ধারকর্মীর ইসলাম গ্রহণ করার খবরটিকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh