আমি ইসরাইলি পণ্য কোকাকোলা খাইনা – ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এমন কথা বলেন নি

Published on: June 16, 2021

পর্তুগালের ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা একটি বক্তব্য সামাজিকমাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। ‘’আমি ইসরাইলি পণ্য কোকাকোলা খাইনা- বলেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’’ এই শিরোনামে বিভিন্ন খবর এবং ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এমন কথা বলেন নি। তিনি ১৪ই জুন ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টে পর্তুগাল-হাঙ্গেরি ম্যাচের আগে প্রেস কনফারেন্সে স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য কোমল পানীয় কোকাকোলার বদলে পানি খাওয়ার জন্য উপস্থিত সাংবাদিকদের উৎসাহিত করেছিলেন। ইসরাইলের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।

গুজবের উৎস

এই সময় নামক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজ থেকে ১৫ই জুন রাত ৮ টায় এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। পরবর্তী ২০ ঘন্টায় এই খবরটা কমপক্ষে ৭০০ বার শেয়ার করা হয়। অন্য অনেক ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপে এই খবরটা শেয়ার করা হতে থাকে। যেমন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে , এখানে ,এখানে , এখানে





সোশাল মিডিয়া মনিটরিং সাইট ,ক্রাউডট্যাংগল থেকে দেখা যায়, ১৬ই জুন বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই শিরোনামে কমপক্ষে ২৭ টা পোস্ট দেওয়া হয়েছে ফেসবুকের বিভিন্ন জায়গায় এবং ২২ হাজার প্রতিক্রিয়া ( interaction) হয়েছে এই পোস্ট নিয়ে।

খবরগুলো অনুসন্ধান করে দেখা গেল, অধিকাংশই হালালশুপ ডট কম  এবং ডেইলিনিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম নামের দুইটা অনলাইন সংবাদমাধ্যম এর খবর শেয়ার করছে।

শিরোনাম হিসেবে ‘আমি ইসরাইলি পণ্য কোকাকোলা খাইনা’ বলা হলেও , খবরের বিস্তারিত বিবরনে ইসরাইল সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া গেল না।

পুরো খবরটাই এখানে তুলে ধরছি ,

পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রি’শ্চি’য়া’নো রোনালদো সংবাদ স’ম্মে’ল’ন করবেন। সংবাদ স’ম্মে’ল’ন টেবিলে তারা নিজেদের কো’ম’ল পানীয়ের বো’ত’ল রেখেছে ইউরোর অফিশিয়াল স্পনসর ‘কোকাকোলা’। এটা তাদের প্র’চা’রেরই একটা অংশ। কিন্তু সিআর সেভেন মুডে ছিলেন না। কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোসের স’ঙ্গে সংবাদ স’ম্মে’ল’নে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসার পর তার চোখ পড়ে সামনে সা’জা’নো কোকাকোলার দুটি বো’ত’ল। তৎক্ষণাৎ বোতল দুটি ক্যা’মে’রার লেন্স থেকে সরিয়ে রেখে রোনালদো সবার প্রতি বলেন ‘পানি খান’। রোনালদোর এমন কাণ্ড দেখে সংবাদ স’ম্মে’ল’ন কক্ষে বেশ হা’স্য’র’সের জন্ম হয়। অনেকেই এর পেছনে কারণ কী জানতে চান। আসলে রোনালদো ফি’ট’নে’স নিয়ে চরম নি’য়’মা’নু’ব’র্তি’তা মেনে চলেন। তাই কো’ম’ল পানীয় একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন। এবারের ইউরোতে শি’রো’পা ধরে রাখার চাপ তো আছেই। তার ওপর টু’র্না’মে’ন্টের প্রথম ম্যাচ। তাই এমতাবস্থায় তিনি কোনো স্প’ন’স’র প্রতিষ্ঠানকে খুশি করার মানসিকতায় ছিলেন না। ৩৬ বছর বয়সেও রোনালদো অবিশ্বা’স্য ফি’ট’নে’স ধরে রেখেছেন। ফাস্টফুড ও কো’ম’ল পানীয় বহু আগেই ব’র্জ’ন করেছেন। রোনালদোর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্যা’ট্রি’ক এভরা একবার বলেছিলেন, ‘অ’নু’শী’ল‹নের পর খুব ক্লান্তি নিয়ে তার বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু খাবার টেবিলে দেখলাম শুধু একটা সা’লা’দ, মুরগির বুকের মাংস আর পানি, কোনো পানীয় নেই।’ সংবাদ স’ম্মে’ল‹নে রোনালদো বলেন, ‘এখন আমা’র বয়স ৩৬ বছর। জু’ভে’ন্টা’সে থাকি বা না থাকি সামনে যা কিছুই ঘ’টু’ক না কেন, সেটা আমা’র জন্য ভালোই হবে।’

অর্থাৎ, খবরের বিস্তারিত বিবরণে স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা বলা হলেও ,শিরোনামে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইসরাইলের সম্পর্ক দাবি করে গুজব তৈরি করা হচ্ছে ।

রোনালদো কি বলেছিলেন ?

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলেন। সেদিনের প্রেস কনফারেন্স ও হয়েছিল পর্তুগীজ ভাষায়।

এটা ছিল পর্গুগালের ক্যাপ্টেন রোনালদো এবং পর্তুগালের কোচ সান্তোস এর যৌথ সংবাদ সম্মেলন। লম্বা টেবিলে পাশাপাশি দুইজনেই বসেছিলেন। তাদের সামনে ২ বোতল কোকাকোলা এবং এক বোতল পানি (ব্রান্ড নাম বোঝা যায়নি) ছিল । রোনালদো কোকাকোলার বোতল ২ টা ডান পাশ থেকে সরিয়ে বাম পাশে একটু দূরে (ক্যামেরার ফোকাসের বাইরে) এনে রাখেন। এরপর পানির বোতল খুলে কিছুটা পানি পান করেন , দর্শকদের উদ্দেশ্যে পানির বোতল উচু করেন এবং বলেন , Aqua  (পর্তুগীজ ভাষায় , পানি হল Aqua)

এরপর তিনি ‘এহ কোকাকোলা’ জাতীয় একটা ধ্বনিও করেন।

এরপর সাংবাদিকরা পর্তুগীজ ভাষায় তাকে খেলা নিয়ে প্রশ্ন শুরু করেন।

এ বিষয়ে প্রথম আলো তাদের রিপোর্টে ঘটনা বর্ণনা করেছে এভাবে,

পর্তুগাল
কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোসের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসার পর তাঁর চোখ পড়ে সামনে সাজানো কোকাকোলার দুটি বোতল। তৎক্ষণাৎ বোতল দুটি ক্যামেরার লেন্স থেকে সরিয়ে রেখে রোনালদো সবার প্রতি বলেনপানি খান এরপর একটি পানির বোতল সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন।

ফুটবল সাময়িকী গোল ডট কম তাদের রিপোর্টে লিখেছে,

সোমবার ইউরো-২০২০ এর একটি প্রেসকনফারেন্সে তার সামনে থাকে কোকাকোলয়ার বোতল সরিয়ে দেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। এরপর তিনি রুমের উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশ্যে একটি পানির বোতল উচু করে ধরেন এবং বলেন, কোকাকোলার বদলে সবার পানি পান করা উচিত।  এরপর নাটকীয়ভাবে তিনি তার দৃষ্টি ফেরান এবং অবজ্ঞাভরে উচ্চারন করেন ‘কোকাকোলা’ ।

(Cristiano Ronaldo removed two Coca-Cola bottles from the table in front of him at his pre-match Euro 2020 press conference on Monday before holding up a bottle of water to the room and declaring people should drink water instead. Then, for dramatic effect, he rolled his eyes and said with borderline disgust, “Coca-Cola”.)


সেই প্রেস কনফারেন্সের ইংরেজি ভাষান্তর সহ একটি ভিডিও দেখুন এই ইউটিউব ভিডিওতে। ১২ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে দেখা যায় , কোকাকোলা কিংবা স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি সেদিনের প্রেস কনফারেন্সে। শুধুমাত্র খেলা নিয়েই প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকেরা।

রোনালদোর এমন আচরণের কারণ তাতক্ষনিকভাবে জানা না গেলেও,  সাংবাদিকেরা তার স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং কোমল পানীয় নিয়ে তার অতীত সাক্ষাতকারের কথা বলছেন ।

ডেইলি স্টার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে লিখেছে

ফিটনেস নিয়ে বরাবরই একটু বেশি সচেতন রোনালদো। যে কারণে এ বয়সেও খেলে যাচ্ছেন তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। নিজের সন্তানের উদাহরণ দিয়ে এর আগেও অনেকবারই কোমল পানীয় ও জাঙ্ক ফুড বর্জনের কথা বলেছেন এ তারকা।

এর আগে কোনো এক সাক্ষাৎকারে রোনালদো জুনিয়রের প্রসঙ্গ তুলে পর্তুগিজ অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আমি আমার ছেলের জন্য খুব কঠিন। মাঝে মধ্যে সে কোকা কোলা কিংবা ফান্টা পান করে, সে চিপও খায় এবং সে জানে আমি এটা পছন্দ করি না।’

কোথাও ইজরাইলের সাথে রোনালদোর কোনো বৈরি সম্পর্কের আলামত পাওয়া যায়নি। বরং অতীতে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ইজরাইলের একটি পণ্যের মডেল হয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত খবর এবং ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে ইজরাইলের হারেতজ পত্রিকায়। ইজরাইলের ইন্টারনেট কোম্পানি HOT এর বিজ্ঞাপনটা রোনালদো নিজেও টুইট করেছিলেন ২০১৬ সালে

CR7 supporting Palestine এমন একটা গুজব ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছিল ২০১৯ সালে  । এ এফ পি তখন ফ্যাক্টচেক করে দেখেছে, এই গুজব সত্য নয়। রোনালদো ফিলিস্তিন কে সাপোর্ট করে এমন কিছু বলেন নি।

২০২১ সালের মে মাসেও বাংলাদেশে এই গুজবটা ভাইরাল হয়। এ সময় ফ্যাক্টওয়াচ ও এ সংক্রান্ত ফ্যাক্টচেক রিপোর্টে জানায় , বিষয়টা পুরাই গুজব। রোনালদো ফিলিস্তিনি শিশুদের সাহায্য করছে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সিদ্ধান্ত

আমি ইসরাইলি পণ্য কোকাকোলা খাই না – ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এমন কথা বলেন নি । তবে সোমবার রাতে রোনালদো কোকাকোলার বোতল থেকে পান না করে সাধারণ পানি পান করেছেন এবং অন্যদের ও উৎসাহিত করেছেন। তাই ফ্যাক্টওয়াচের বিচারে এই দাবীটি মিথ্যা ।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab

 

Leave a Reply