এটা কি কোনো মানবকোষের ছবি ?

Published on: [September 25,2021]

“এখন পর্যন্ত পাওয়া মানবকোষের সবচেয়ে ডিটেইলড ছবি এটা” – এই শিরোনামে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে । ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এটা কোনো চিত্র (ফটোগ্রাফ অর্থে) নয় , বরং এটা বিভিন্ন কোষের প্রতিনিধিত্বশীল একটি নকশা । এছাড়া, ভাইরাল পোস্টে দাবী করা হচ্ছে, ছবির এই কোষের মত কোটি কোটি কোষ মানব দেহে রয়েছে ।এটিও সঠিক নয়। এমনকি , এটা কোনো মানব কোষ নয় এবং এই ছবির মত এমন কোনো কোষ মানব দেহে বা অন্য কোনো উদ্ভিদ/প্রাণীর দেহে উপস্থিত নেই।

গুজবের উতস

ভারতে এবং বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময়েই এই কোষের ছবিটা ভাইরাল হতে দেখা গেছে। তবে বাংলা ভাষায় সম্প্রতি এই ছবিটা পোস্ট করতে দেখা গেছে ২৪শে সেপ্টেম্বর দুপুর ২ টা ১৯ এ, আরিফ আজাদ নামক আইডি থেকে। পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় এই ছবিটা আরো অনেকের শেয়ারের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ।

ভাইরাল এই পোস্টে বলা হয়, এখন পর্যন্ত পাওয়া মানবকোষের সবচেয়ে ডিটেইলড ছবি —– এটা কেবল একটা কোষের চিত্র, এরকম কোটি কোটি কোষ আছে আমাদের প্রত্যেকের দেহে!

এই ছবিটা কবে কোথায় কোন বিজ্ঞানী তুলেছেন, সেই তথ্য উল্লেখ করা হয়নি এই পোস্টে। এছাড়া , মানবদেহের কোন অংশের ছবি এটা, সেটাও জানানো হয়নি ভাইরাল পোস্টে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

সেল সিগনালিং টেননোলজি  নামক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য এই ছবিটা তৈরি করেছিলেন সায়েন্টিফিক এনিমেটর    Evan Ingersoll এবং Gael McGill  ।  গেল ম্যাকগিল এর ওয়েবসাইটে এই ছবিটা দেখা যাচ্ছে। ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে, X-Ray, NMR এবং cryo-electron microscopy dataset ব্যবহার করে সেল সিগনালিং টেকনোলজি এর জন্য eukaryotic cell এর এই 3D Rendering টা তৈরি (created) করা হয়েছে।

সেল সিগনালিং টেকনোলজির ওয়েবসাইটে এই ছবিটার বিভিন্ন অংশ আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন অংশের নাম ও উল্লেখ করা হয়েছে।

AAP এর অনুসন্ধান

গত আগস্ট মাসে অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছবিটা ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে , It is the most detailed image of a human cell to date ক্যাপশন সহযোগে। তখন অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা AAP যোগাযোগ করেছিল ছবিটির মূল নির্মাতা Evan Ingersoll এর সাথে। তিনি AAP কে জানান, ‘এই ছবিটাকে সত্যিকারের মানব কোষের ছবি দাবি করাটা হবে Extremely Misleading


তিনি জানান, একটি কোষের মধ্যে সংগঠিত বিভিন্ন বিক্রিয়ায় অংশগ্রণকারী অণু (molecule) দের আঁকা (illustrate) হয়েছে এই ছবিতে। স্কেল অনুযায়ী আঁকা হয়নি, বরং দৃষ্টি নন্দন করার জন্য এবং কম জায়গায় সব দেখানোর জন্য বিভিন্ন প্রান্তের অনুগুলোকে কাছাকাছি এনে দেখানো হয়েছে। এটাকে তুলনা করতে পারেন ক্লাসের একদল সহপাঠীর সাথে। সেলফি তোলার জন্য তারা হয়ত একসাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ছবি তুলবে, কিন্তু ক্লাসের কোনো সময়েই তারা এত কাছাকাছি থাকবে না।

একই সাথে, এই একটি কোষে বিভিন্ন উপাদান একসাথে দেখানো হয়েছে ,যেটা বাস্তবে ঘটবে না। যেমন-এই কোষে একই সাথে স্তন ক্যান্সার এবং আলঝেইমার এর উপাদান দেখানো হয়েছে ।

(প্রসঙ্গত উল্লেখ, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, স্তন ক্যান্সার রোগীর আলঝেইমার হয়না , আবার আলঝেইমার থেকে সেরে ওঠা রোগী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ, একই কোষে একই সময়ে এই দুইটা উপাদান থাকেনা। কিন্তু বোঝানোর সুবিধার্থে  ইঙ্গারসোল এবং ম্যাগগিল তাদের কোষে এই দুইটাই দেখিয়েছেন একসাথে।)

সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে, ভাইরাল হওয়া এই ছবিটা বাস্তবে সম্ভব নয়। এটা শুধুমাত্র একটা ইলাস্ট্রেশন । অনুবীক্ষণযন্ত্র, এক্সরে, NMR এবং অন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করে তারপরে শিল্পীর দক্ষতায় আঁকা হয়েছে এই ছবিটা।

কোষের বর্ণ

অধিকাংশ কোষ স্বচ্ছ কিংবা বর্ণহীন। ব্যবহারিক ক্লাসে শিক্ষকরা ছাত্রদের কোষ ভালভাবে দেখানোর জন্য এতে বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থ ব্যবহার করে রঙিন করে তোলেন

কোষের ছবি আকানোর ক্ষেত্রেও শিল্পীরা একইভাবে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করেন, যা কোষের সত্যিকার রঙ নয়।

উইকিপিডিয়া থেকে করোনাভাইরাস এর নিচের এই দুইটা ছবি নেওয়া হয়েছে। প্রথম ছবিটা ইলেক্ট্রন মাইক্রোগ্রাফ প্রযুক্তিতে পাওয়া করোনাভাইরাসের স্বচ্ছ বর্ণহীন ছবি। দ্বিতীয়টা, শিল্পীর সৃজনশীলতায় আঁকা করোনাভাইরাসের রঙিন ছবি।

ভাইরাল ছবিতে যেহেতু প্রচুর রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটা ইলাস্ট্রেশন। আসল ছবি নয়।

আরো কিছু অসঙ্গতি

ভাইরাল পোস্টে দাবী করা হয়েছে,   এটা কেবল একটা কোষের চিত্র, এরকম কোটি কোটি কোষ আছে আমাদের প্র‍ত্যেকের দেহে!

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এ দাবীটা সম্ভব নয় । এরকম একটাও কোষ নেই আমাদের দেহে। কোটি কোটি কোষ তো দূরের কথা।

এছাড়া, ভাইরাল পোস্টে দাবী করা হচ্ছে, এটা মানবদেহের কোষ। এই দাবীও সত্য নয়। এটা eukaryotic cell এর বিভিন্ন উপাদানের ইলাস্ট্রেশন।

সকল জীবকোষ কে ২ প্রকারে ভাগ করা যায়। প্রোক্যারিওটিক কোষ, এবং ইউক্যারিওটিক কোষ।
এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হল নিউক্লিয়াস। যে সকল কোষে নিউক্লিয়াস আছে  আছে, তাদেরকে ইউক্যারিওটিক সেল বলে। আর যে সকল কোষে নিউক্লিয়াস এবং সুদৃঢ় কোষ প্রাচীর নাই, তাদেরকে প্রোক্যারিওটিক সেল বলে।
শুধুমাত্র ব্যাক্টেরিয়া আর আর্কিয়া হল প্রোক্যারিওয়টিক।বাকি সব উদ্ভিদ এবং প্রাণীর কোষ ইউক্যারিওটিক।

Prokaryotes vs. Eukaryotes: Definition and Characteristics

কাজেই , ভাইরাল ইউক্যারিওটিক কোষের ছবিটিকে শুধুমাত্র ‘মানবকোষের ছবি’ দাবী করা সঠিক নয়।

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

ভাইরাল হওয়া ছবিটি একটি ইউক্যারিওটিক কোষ এর ইলাস্ট্রেটেড ছবি অর্থাৎ আঁকা ছবি। এটা মানবদেহের একক কোনো কোষের অনুবীক্ষণযন্ত্রে তোলা ছবি নয়। মানবদেহে এমন কোনো একটি কোষ ও নেই । আলোচ্য ছবিতে ইউক্যারিওটিক কোষের বিভিন্ন অংশ একত্রে দেখানো হয়েছে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠাণের গবেষণা কাজের অংশ হিসেবে। সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টকে ‘আংশিক মিথ্যা’  সাব্যস্ত করছে।

তথ্যসূত্র-

১। AAP Factcheck
২। Cell Signaling Technologies

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply