“ফ্রিজে ডিম রেখে বড় বিপদ ডেকে আনছেন না তো!” – ভূয়া সাবধান বাণী!

Published on: October 3, 2021

সম্প্রতি “ফ্রিজে ডিম রেখে বড় বিপদ ডেকে আনছেন না তো!” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল থেকে। খবরগুলোতে উল্লেখিত তথ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে “ফ্রিজে ডিম রাখলে তার মধ্যে একধরনের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়।“ অথচ বিশ্বের একাধিক সুপরিচিত স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইট বলছে, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোত্তম উপায় ডিম রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকায় এসব খবর জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এটিকে “গুজব” সাব্যস্ত করেছে।

সম্প্রতি এবং গতমাসে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে খবরগুলো শেয়ার হয়েছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে।


উক্ত খবরটির বিস্তারিত অংশ ধরে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, খবরটির একাংশ হুবহু কপি করা হয়েছে ২৩ অক্টোবর ২০২০ তারিখে জাগো নিউজ থেকে প্রকাশিত একটি খবর থেকে। “ফ্রিজে ডিম রাখলে কী হয়?” শিরোনামের খবরটির শুরুতেই বলা হয়েছে, “ফ্রিজে ডিম রাখা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলেই দাবি গবেষকদের। গবেষকদের মতে, ফ্রিজের তাপমাত্রা শূন্যরও অনেক নীচে থাকে বলে খাবার রাখা নিরাপদ, সহজে নষ্ট হয়ে যায় না। কিন্তু ফ্রিজে ডিম রাখলে তার মধ্যে এক ধরনের ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়া জন্ম নেয়। আমরা রান্না করার সময় সাধারণত ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে সরাসরিই ব্যবহার করে ফেলি! তাই ডিমে জন্ম নেওয়া ব্যাকটেরিয়া জীবিত অবস্থায় থাকে এবং খাদ্যে বিষক্রিয়া ও নানা রকম সংক্রমণ ঘটতে পারে।“ উল্লেখ্য যে, খবরটিতে কোনো গবেষকের নাম এবং খবরটির সাথে প্রাসঙ্গিক কোনো গবেষণার বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয় নি।

ইউএস ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) বলছে, ব্যাকটেরিয়া থেকে অসুস্থতা রোধ করতে ডিম রেফ্রিজারেটরে রাখুন, কুসুম শক্ত না হওয়া পর্যন্ত ডিম রান্না করুন, এবং ডিম দিয়ে রান্না করা খাবার ভালোভাবে রান্না করুন। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া যা অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে তা উষ্ণ তাপমাত্রায় (৪০° ফারেনহাইট থেকে ১৪০° ফারেনহাইট এর মধ্যে) দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

ফুড সেফটি এন্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া বলছে, ডিম রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করলে তা দীর্ঘদিন ভালো থাকে এবং এতে জীবাণু জন্মানোর ঝুঁকি কমে যায়।

স্বাস্থ্যবিষয়ক সুপরিচিত ওয়েবসাইট healthline.com বলছে, ডিমের সাদা অংশে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সুরক্ষা রয়েছে, যা ডিমকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে। তবে ডিমের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোত্তম উপায় এটি রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা।

নীচের তালিকাটিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে  কতক্ষণ ডিম ভালোভাবে সংরক্ষণ করে রাখা যাবে এবং কিভাবে বুঝবো এটি ফেলে দিতে হবে –

উপদ্রব যখন সালমোনেলা

“সালমোনেলা” হল এক ধরনের জীবাণু যা অনেক উষ্ণ রক্তের প্রাণীর অন্ত্রে বাস করে। এটি পুরোপুরি নিরাপদ যখন পশুর অন্ত্রনালীর মধ্যে থাকে। কিন্তু যখন এটি খাদ্যে প্রবেশ করে তখন মারাত্মক অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। সালমোনেলার সংক্রমণের ফলে বমি এবং ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয় যা বয়স্ক, শিশু এবং দূর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষদের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

একটি ডিম সালমোনেলা দ্বারা বাহ্যিকভাবে দূষিত হতে পারে, যদি এর জীবাণু ডিমের খোসায় কোনোভাবে ঢুকে যায়। অথবা যদি মুরগি নিজেই সালমোনেলা বহন করে এবং জীবাণুগুলো খোসা তৈরির আগে ডিমের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়।

দূষিত ডিম থেকে সালমোনেলার প্রাদুর্ভাব রোধ করতে ডিম ভালোভাবে সংরক্ষণ এবং রান্না করা অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) এর নীচে ডিম সংরক্ষণ করলে সালমোনেলার ​​বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় এবং ডিমকে কমপক্ষে ১৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপে রান্না করলে ডিমে থাকা যে কোনও জীবাণু মারা যায়।

ডিমের হিমায়ন প্রয়োজনীয় কিনা তা আপনার অবস্থানের উপর নির্ভর করে, যেহেতু সালমোনেলা’র চিকিত্সা দেশ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।

 রেফ্রিজারেটরে ডিম সংরক্ষণ নিয়ে দুই রকম অবস্থানে আমেরিকা এবং ইউরোপ

বেশিরভাগ আমেরিকানরা রেফ্রিজারেটরে ডিম সংরক্ষণ করলেও অনেক ইউরোপিয়ান তা করেন না। কারণ ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের কর্তৃপক্ষ বলে ডিম ফ্রিজে রাখা অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ঘরের তাপমাত্রায় ডিম সংরক্ষণ করা অনিরাপদ বলে বিবেচিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত ডিম সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেশন প্রয়োজন হয়ে থাকে। সেখানে ডিম বিক্রির আগে সেগুলো জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। গরম, সাবান জলে ধুয়ে একটি জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করা হয় প্রতিটি ডিমকে, যা খোসায় থাকা যেকোন জীবাণুকে মেরে ফেলে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসহ মুষ্টিমেয় অন্যান্য দেশে।

ধোয়ার প্রক্রিয়া ডিমের কিউটিকলকেও অপসারণ করতে পারে, যা ডিমের খোসার পাতলা স্তর রক্ষা করতে সাহায্য করে থাকে। কিউটিকল অপসারিত হলে জীবাণুমুক্তকরণের পর ডিমের সংস্পর্শে আসা যে কোন ব্যাকটেরিয়া সহজেই খোসা ভেদ করতে সক্ষম হবে এবং ডিমের উপাদান দূষিত করতে পারবে।

যদিও রেফ্রিজারেশন জীবাণু হত্যা করে না, তবে এটি জীবাণুর সংখ্যা সীমিত করে অসুস্থতার ঝুঁকি কমায়। এটি ডিমের খোসায় প্রবেশ করতে ব্যাকটেরিয়াকেও বাধা দেয়। তবুও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিম ফ্রিজে রাখার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। একবার ডিম রেফ্রিজারেটরে রাখা হলে তা ব্যবহারের আগ পর্যন্ত রেফ্রিজারেটরেই রাখতে হবে। আর্দ্রতা জীবাণুর জন্য খোসা ভেদ করা সহজ করে তোলে।

অনেক ইউরোপীয় দেশ তাদের ডিম রেফ্রিজারেটরে রাখে না, যদিও ইউরোপ  ১৯৮০ এর দশকে সালমোনেলা মহামারীর সম্মুখীন হয়েছিল।   যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডিম ধোয়ার এবং হিমায়নের জন্য প্রবিধান বাস্তবায়ন করছে,  সেখানে অনেক ইউরোপীয় দেশ সংক্রমণ রোধ করার জন্য সালমোনেলার ​​বিরুদ্ধে স্যানিটেশন এবং মুরগিকে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনে ডিম পাড়ার মুরগিকে এই জীবাণুর সবচেয়ে সাধারণ প্রজাতির বিরুদ্ধে টিকা দেওয়ার পর, দেশে সালমোনেলায় সংক্রমণের সংখ্যা কয়েক দশকের মধ্যে তাদের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ডিম ধোয়া এবং জীবাণুমুক্ত করা অবৈধ। যদিও সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডস এর ব্যতিক্রম।

রেফ্রিজারেটরে অন্যান্য সুবিধা এবং অসুবিধা

রেফ্রিজারেটরে ডিম রাখার কিছু সুবিধা এবং অসুবিধাও রয়েছে। তবে এটি নির্ভর করে আপনার অবস্থানের উপর।

সুবিধাসমূহ:

রেফ্রিজারেশনের মাধ্যমে একটি ডিম অনেকদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়।

ডিম রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা জীবাণু নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোত্তম উপায়।

এটি ডিমকে ঘরের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে সতেজ রাখে।

যদিও ঘরের তাপমাত্রায় সংরক্ষিত একটি ডিমের কয়েকদিন পরে গুণগত মান কমতে শুরু করবে এবং ১-৩ সপ্তাহের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। রেফ্রিজারেটরে রাখা ডিম এর থেকে কমপক্ষে দ্বিগুণ সময় গুণমান এবং সতেজতা বজায় রাখবে।

রেফ্রিজারেটরে ডিম রাখার কিছু সুবিধা থাকলেও এর অসুবিধাও রয়েছে:

ডিম রেফ্রিজারেটরে থাকা গন্ধ শোষণ করতে পারে। যেমন টাটকা কাটা পেঁয়াজ।

ডিম রেফ্রিজারেটরের দরজায় রাখা উচিত নয়। অনেকে তাদের ডিম ফ্রিজের দরজায় রাখে। এটি খুললে ডিম প্রতিবার তাপমাত্রায় ওঠানামার শিকার হতে পারে, যা ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারে এবং ডিমের প্রতিরক্ষামূলক ঝিল্লি নষ্ট করতে পারে। রেফ্রিজারেটরের পিছনে একটি তাকের উপর ডিম রাখা সবচেয়ে ভালো।

ঠান্ডা ডিম বেকিংয়ের জন্য সেরা নাও হতে পারে। কিছু শেফ দাবি করেন যে ঘরের তাপমাত্রার ডিম বেকিংয়ের জন্য সেরা। যেমন, কেউ কেউ রেফ্রিজারেটরের ডিম ব্যবহারের আগে ঘরের তাপমাত্রায় আনার পরামর্শ দেন। যদি এটি আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে ঘরের তাপমাত্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত ডিম রেখে দেওয়া নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তবুও, আপনি ডিম নিরাপদ তাপমাত্রায় রান্না করতে ভুলবেন না।

উপরোক্ত তথ্যপ্রমাণ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট, রেফ্রিজারেটরে ডিম রাখার কোনো বড় বিপদ বা ঝুঁকি নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ না থাকায় মিথ্যা শিরোনাম এবং তথ্য সংবলিত খবরগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বিবেচনায়, ফ্যাক্টওয়াচ “ফ্রিজে ডিম রেখে বড় বিপদ ডেকে আনছেন না তো!” শিরোনামে খবরগুলোকে “গুজব” সাব্যস্ত করেছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply