দাঁড়িয়ে পানি পান করা যাবে না — একথা কি বিজ্ঞান বলেছে ?

Published on: January 11, 2023

বিজ্ঞানও বলছে দাঁড়িয়ে পানি পান করা যাবে না- গতকাল এমন একটি পোস্ট দেশের মূলধারার পত্রিকা দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর রেফারেন্সে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। তবে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান-স্বীকৃত কোনো গবেষণাতেই দাঁড়িয়ে পানি পান করার অপকারিতা  বিষয়ে কখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিটিকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

গুজবের উৎস

গতকাল বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর বরাত দিয়ে ব্যবহার অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীই নিজেদের ফেসবুক পেজ এবং প্রোফাইল থেকে এই তথ্যটা শেয়ার করতে থাকেন। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ,এখানে , এখানে , এখানে , এখানে।

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

দাবি ১

Ummul Qura.BD এর পোস্টে উল্লেখ করা হয় শরীরে হওয়া পানির ঘাটতি পূরণে দাঁড়িয়ে পানি খাওয়া ঠিক নয়। কারণ এতে শরীরে ডিটক্সিফিকেশান ঠিকভাবে হবে না। উপরোন্তু, শরীরের দূষিত পদার্থ শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে না গিয়ে তা কিডনী ব্লাডারে জমা হয় এবং এতে স্নায়ুতন্ত্রে চাপ পড়ে!”

কিডনির কার্যকারিতা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, কিডনীর মূল কাজ ই হলো শরীরের রক্ত তথা তরল পদার্থকে পরিশোধন করে শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেওয়া!  তাই যেভাবেই পানি খাওয়া হোক না কেন তা অবশ্যই কিডনীতেই পৌঁছাতে হবে সঠিকভাবে পরিশোধিত হওয়ার জন্য।

বরং যাদের শরীরের রক্ত বা তরল ঠিকমতো কিডনীতে পৌঁছে পরিশোধন হতে পারে না, তাদেরকেই ডায়ালাইসিস করে মেশিনের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে কিডনীর কাজটি করে যেতে হয়।

আর শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করার একমাত্র সহজ উপায় তাকে মূত্রের মাধ্যমে বর্জ্য হিসাবে বের করে দেওয়া। আর ব্লাডার বা মূত্রথলিতে যদি সেই দূষিত পদার্থ জমা না হয় তবে মানুষের মূত্র ত্যাগ করাও সম্ভব হবে না বৈকি! ফলে এই দাবিটি অমূলক।


দাবি ২

পোস্টে আরো বলা হয়, দাঁড়িয়ে পানি পান করা হলে তা খুব দ্রুত শরীরের বিভিন্ন অংশে চলে যায় এবং তা ফুসফুস হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করে।

অর্থাৎ, এখানে ঘুরিয়ে দাবি করা হচ্ছে, বসে পানি পান করা হলে তা ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করবে না ।

তবে মানবদেহের আভ্যন্তরীণ অঙ্গ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাচ্ছে, পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ (পাকস্থলীসহ) এর সাথে ফুস্ফুস ও হৃদযন্ত্রের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই পান করা পানি কিভাবে ফুস্ফুস বা হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করবে সেটা বোধগম্য নয়।

মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকেই আমরা জেনেছি, খাদ্যের প্রধান ৬ টি উপাদান ( শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ লবণ, পানি) এর মধ্যে ৩ টা উপাদান ( ভিটামিন, খনিজ লবন, পানি) দেহ সরাসরি গ্রহণ করতে পারে। আর ৩ টি উপাদান ( শর্করা, আমিষ, স্নেহ) কিছু এনজাইমের সাহায্যে পরিপাক হওয়ার পর তারপর গ্রহণ করতে পারে।

হেলথলাইন এর এই নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, মুখ দিয়ে পানি পান করার পরে সেটা পাকস্থলী হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহদান্ত্রে যায়। অধিকাংশই পানিই ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে রক্তনালীতে শোষিত হয়। কিছু পানি বৃহদান্ত্র থেকে শোষিত হয়।  পানি পান করার পর সর্বনিম্ন ৫ মিনিট পরেই এই পানি দেহকোষে পৌছে যায়।

দাঁড়িয়ে বা বসে — যে অবস্থায়ই পানি পান করা হোক, সেটা মুখছিদ্র থেকে পাকস্থলি এবং গলবিল পর্যন্ত একটা সোজা পথ দিয়েই প্রবাহিত হবে। শোয়া অবস্থায় পানি পান করলে এটা ঈষৎ হেলানো পথ অতিক্রম করবে, কিন্তু দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় তেমন কোনো পার্থক্য হবে না।

দাবি ৩

এছাড়া আরো দাবি করা হয়েছে ফুসফুস হৃদযন্ত্রের কাজ বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ার পাশাপাশি যেহেতু সরাসরি পানি শরীরে ঢুকে যায় তাতে নাকি প্রয়োজনীয় পুষ্টি ভিটামিন যকৃত পরিপাকতন্ত্রে পৌঁছায় না!”

প্রথমত, পানিতে কোনো ক্যালরি বা পুষ্টিমান নেই ।

দ্বিতীয়ত, আগেই বলা হয়েছে পানি বসে কিংবা দাঁড়িয়ে যেভাবেই পান করা হোক না কেন তা সরাসরি খাদ্যনালী দিয়ে পরিপাকতন্ত্রেই পৌঁছাবে।

আমাদের শরীরের গঠনতন্ত্রটিই এমন। বসা বা দাঁড়িয়ে থাকার কারণে আমাদের শরীরের উপরিভাগের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় না।

এখানে জেনে রাখা ভালো যে, খাদ্যনালী কোনো ফাঁপা নল নয় যে পানি পান করার সাথেসাথেই দ্রুতবেগে তা শরীরের নিচের দিকে আছড়ে পড়ে পরিপাকতন্ত্রকে সজোরে আঘাত করবে!

বরঞ্চ খাদ্যনালীর সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমেই খাদ্য ও পানীয় ধীরে ধীরে পাকস্থলীতে পৌঁছে।

Aquasana নামক একটি পানি শোধনকারী যন্ত্র প্রতিষ্ঠান এর ওয়েবসাইটে Water’s journey through the body শীর্ষক নিবন্ধে বলছে , অন্যান্য খাবার যেখানে শরীরে হজম (digested) হয়, সেখানে পানি হজম হওয়ার দরকার হয়না । এটা সরাসরি শোষিত (absorbed) হয়। এই শোষণ প্রক্রিয়া শুরু হয় মুখ দিয়ে পানি গ্রহণের মুহুর্ত থেকেই। মুখ ছিদ্র থেকে পাকস্থলী,ক্ষুদ্রান্ত্র ,বৃহদান্ত্র হয়ে প্রান্তিক কোষে পৌছাতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। এই পুরাটা সময় যদি তৃষ্ণার কারণে সে দীর্ঘসময় ধরে পানি পান করতেই থাকে, তাহলে প্রয়োজনের তুলনায় শরীরে অনেক বেশি পানি প্রবেশ করবে। এ কারনে মানুষের মস্তিষ্কের সাথে মুখের একটি কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে । মস্তিষ্ক আর শরীরে এই সমন্বয়ের ফলশ্রুতিতে পানি পানের পর খুব অল্প সময়েই পরিতৃপ্তির একটি অনুভব আমরা পাই।

সুতরাং পানি খাওয়ার সাথে সাথেই সেটা দ্রুত সারা শরীরের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে শারীরিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে — এমন কোনো সম্ভাবনাই আমাদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় নেই!

পানি কিভাবে শরীরে রক্তের মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করে ও বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান শরীরে বহন করে নিয়ে যায় তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা চিত্রসহ পাওয়া যাবে এই লিংকটি থেকে…

অন্যান্য ফ্যাক্টচেকারদের অনুসন্ধান

skeptics.stackexchange.com এর এই নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, দাঁড়িয়ে পানি পান করা অস্বাস্থ্যকর — এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রুপ ‘ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান’ এ আহনাফ তাহমিদ জানাচ্ছেন, দাঁড়িয়ে পানি পান করার স্বাস্থ্যঝুঁকি এখনো কোনো গবেষণায় প্রমাণিত নয়।

বিজ্ঞানপ্রিয় পরিবার গ্রুপে De Rifat জানাচ্ছেন, পরিপাকতন্ত্রের কাজ আপনাআপনি নিয়ন্ত্রিত হয়, এক্ষেত্রে বসে থাকা কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা এমনকি শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলেও প্রভাব পড়বে না।

সারমর্ম

আলোচ্য গুজবে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটির উপরে জোর দেওয়া হলেও, দাঁড়িয়ে পানি পান করার ক্ষতির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা পাওয়া যায়নি। অন্য যেসব দাবি করা হচ্ছে, (পানির পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যাবে কিংবা দূষিত পদার্থ কিডনীতে জমা হবে), সেগুলোরও কোনো ভিত্তি নেই। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh