এডওয়ার্ড সাঈদ কি ইজরাইলি সৈন্যদের দিকে ঢিল ছুঁড়ছিলেন?

সারোয়ার তুষার

Published on: October 9, 2023

 

উপরের ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে ভুবনবিখ্যাত তাত্ত্বিক ও লড়াকু বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ ঢিল ছুঁড়ছেন। পাশে তাঁর ছেলে। কিন্তু বিভিন্ন উপলক্ষে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া হোমফিডে সাঈদের ঢিল ছোঁড়ার ছবিখানা ভাসতে দেখা যায়, এবং নানা কিসিমের মন্তব্য দেখা যায়। বলা বাহুল্য, পক্ষে-বিপক্ষের নানা মতামত মূল ঘটনা সম্পর্কে বেখবর থেকে করা মন্তব্য। একপক্ষ বলতে চায়, দ্যাখো এই হলো বুদ্ধিজীবীর ‘আসল’ দায়িত্ব! মানে সম্মুখ সমরে বা রাজপথে গিয়া পুলিশ বা সেনাবাহিনীকে ইট-পাটকেল মারার ‘বিপ্লবী’ সাহস না থাকলে কিসের বুদ্ধিজীবী! মোটাদাগে এরকম একটা টোন থাকে এ ধরনের বক্তব্যে।

 

বিশেষত “বুদ্ধিজীবীর দায়/করণীয়” সংক্রান্ত আলোচনায় সাঈদের এই ইট-পাথর মারার ছবি হাজির হয় এবং যে-সকল বুদ্ধিজীবীরা অ্যাক্টিভিজম না করে কেবল চিন্তা বা লেখালেখি বা কথা বলার প্রতিই আগ্রহী তাদের ‘পলায়নপর’ ও ‘ভীরু’ হিসেবে হাজির করার চেষ্টা থাকে এসব বক্তব্যে। কারণ তাদের মধ্যে ইট-পাটকেল মারার সাহস দেখা যায় না! ফলে বলতে চাওয়া হয় যে, এহেন বুদ্ধিজীবীরা ‘মেরুদণ্ডহীন’; তারা সাঈদের মতো ‘সাহসী’ নন!

 

এখন, বুদ্ধিজীবীরা রাজপথে থাকবেন কি থাকবেন না তথা অ্যাক্টিভিজম করবেন কি না সেইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রশ্ন। এখানে আমি এ বিষয়ে আলাপ করতে চাই না। কিন্তু উল্লিখিত মন্তব্যকারীরা সাঈদের ছবিটাকে ভুলভাবে বা আজগুবি ব্যাখ্যাসহ হাজির করে থাকেন। বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা সম্পর্কে তাদের উইশফুল থিংকিং-এর চাপের কারণে তারা কখনো মূল ঘটনার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেন নাই।

 

আসলে এই ছবিতে ইসরাইলি সৈন্যদের দিকে সাঈদ কোনো ঢিল ছোঁড়েন নাই; বরং লেবাননের ভূমি ইসরাইলি সৈন্যরা ত্যাগ করার পর তথা দখলমুক্ত হওয়ার পর সাঈদ সেখানে গিয়ে ঢিল ছুঁড়েছিলেন এটা নির্দেশ করতে-যে লেবাননের ভূমি ইসরাইলি সৈন্যমুক্ত হলো, এখন চাইলেই ঢিল ছোঁড়া যায়। এটা ছিল দখলদারত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার একটা প্রতীকী উদযাপন

 

কিন্তু ছবিটা আমাদের এখানে একজন বুদ্ধিজীবী সম্মুখে সমরে মিলিটারিদের সাথে লড়ছেন এই অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়। এই ব্যাখ্যা মিসলিডিং। সাঈদ আজীবন ইজরায়েল বিরোধী অবস্থান জারি রেখেছিলেন। এমনকি তিনি ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনেও জড়িত ছিলেন। পরে মতভিন্নতার কারণে ওই সংগঠন ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সাঈদ ওই মুহূর্তে যা করছিলেন না, তা সাঈদের নামে প্রচার করার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নাই।

 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ছবিখানা নিয়ে বিভ্রান্তির ইতিহাস অবশ্য হালের নয়। সাঈদ যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, অর্থাৎ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীও এই ছবিটাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে সাঈদ “ভায়োলেন্ট অ্যাক্ট”-এ জড়িয়েছেন, সুতরাং তাকে শাস্তি দেয়া হোক, এমনকি সাঈদকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হোক— এমন দাবিও তুলেছিলেন। সে সময় শিক্ষার্থীদের পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে ধুন্ধুমার বিতর্ক চলছিল। (Bilgrami 2014)

 

এর ফলে বেচারা সাঈদকে ভালোই নাজেহাল হইতে হইসিল আর পেরেশানি পোহাইতে হইসিল। যেমন এ ছবি নজরে আসার পর ভিয়েনার ফ্রয়েড সোসাইটি সাঈদের একটা পূর্বনির্ধারিত লেকচার বাতিল করে। এডওয়ার্ড আলেক্সান্ডার নামের এক সাংবাদিক এক ম্যাগাজিনে সাঈদকে “প্রফেসর অব টেরর” বলে সাব্যস্ত করেন। এসবের জবাবে সাঈদ লেখেন, “It was a pebble; there was nobody there. The guardhouse was at least half a mile away.”

 

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা যেভাবে সুরাহা করসিল তা-ও বেশ কৌতুকপ্রদ। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট পত্রিকায় লিখলেন-যে, সাঈদের এই কর্মকাণ্ড (ঢিল ছোঁড়া) বাকস্বাধীনতা ও প্রকাশের স্বাধীনতার নীতির আওতায় বিবেচনা করতে হবে। ব্যস, ওমনি সাঈদ-বিরোধী প্রফেসর-স্টুডেন্ট কোরাম সমস্ত গোলমাল থামাইয়া দিয়া বিরাট শান্ত হইয়া যায়। বাক ও প্রকাশের স্বাধীনতার এক প্রায় ধর্মতাত্ত্বিক অনুশাসন পুরো ঘটনায় লক্ষ করা যায়।

 

সাঈদের কলিগ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক এবং তাত্ত্বিক আকীল বিলগ্রামির বইয়ে এ ঘটনার দীর্ঘ বিবরণ পাওয়া যায়। বিলগ্রামিকে উদ্ধৃত করছি:

[A couple of years ago it was reported in the newspaper that my colleague Edward Said threw a stone on a recently liberated site in Lebanon in the direction of abuilding housing some Israeli guards. He was with his son, and he did so in order to let off steam and express some satisfaction at the liberation of an area, which the occupying Israeli forces had evacuated. Some professors and students at Columbia University demanded that action be taken against Said for a violent act, suggesting that he even be asked to leave the university. There was a lot of discussion and much controversy was exchanged in the student newspaper. Now even if one thinks as I do that the demand was pre-posterous and farcical (though I am sure it did not seem particularly farcical to poor Said who was harassed-as he so often was-by the most disagreeably malicious and false propaganda about it), it was interesting to see what a lot of calm and clarity was brought, even among those making the preposterous demand, when the provost wrote in the newspaper to say that Said’s throwing the stone is to be subsumed under the principle of free speech and expression. (“Secularism, Multiculturalism and the very Concept of law”, by Akeel Bilgrami, SECULARISM, IDENTITY AND ENCHANTMENT; Harvard University Press, 2014) ]