ভুয়া সাহায্যের আবেদন ভাইরাল

Published on: April 27, 2023

সম্প্রতি একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যেখানে একটি অসুস্থ শিশুর ছবি পোস্ট করে চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন করা হচ্ছে। পোস্টটিতে দেখা যাচ্ছে শিশুটির মুখণ্ডল সেলাই করা এবং গালের ভিতর নল ঢুকানো। 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে একই ধরণের ছবি ব্যবহার করে সাহায্যের পোস্ট ভিয়েতনামে স্যোশাল মিডিয়ায়ও করা হয়েছিলো। ২০২১ সালে স্যোশাল মিডিয়ায় এসব ভুয়া সাহায্যের পোস্ট করে পান ভান তাই নামক ভিয়েতনামী এক নাগরিক ১৬০০ মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলো। কারণে পুলিশ পান ভান তাইকে গ্রেফতার করেছিলো, কারণ পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছিল এই সাহায্যের পোস্টটি ভুয়া। কারণে ভাইরাল ফেসবুক পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচমিথ্যাহিসেবে চিহ্নিত করছে। 


সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরনঃ এই নিবন্ধে কয়েকটি অসূস্থ শিশুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এই বিষয়ে সংবেদনশীল পাঠকদের এই নিবন্ধটি এড়িয়ে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে।  

গুজবের উৎস 

ফেসবুকে ভাইরাল পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে,এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

 ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবিটি গুগল ইমেজ সার্চ করলে ভিয়েতনামের বেশকিছু গণমাধ্যম এবং সরকারি ওয়েবসাইটে ছবিটি পাওয়া যায়। গুগল ইমেজ সার্চে পাওয়া সব তথ্য ভিয়েতনামী ভাষায় ছিলো। এ কারণে তথ্যগুলো জানার জন্য গুগল ট্রান্সলেশনের সহায়তা নেয়া হয়েছে।

ভিয়েতনাম সরকারের জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের (ভিয়েতনামী ভাষায় Bo Cong an) ওয়েবসাইটে ১৭ই ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে ভাইরাল ছবিটি ব্যবহার করে “তথ্য জালিয়াতি এবং প্রতারণা করে ১৬০০ ভুক্তভোগী মানুষের থেকে অনুদান গ্রহণের জন্য আটক” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

মূল সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে ভিয়েতনামের নে অ্যান (Nghe An) প্রদেশের থাই হোয়া (Thai Hoa) শহরের বসবাসকারি একজন বাসিন্দা পুলিশের কাছে স্যোশাল মিডিয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে ২ মিলিয়ন ভিয়েতনামী ডং (বাংলাদেশি টাকায় ৯১৬৩ টাকা; ১ ডং=০.০০৪৫ টাকা) অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার রিপোর্ট করে। সেই বাসিন্দা একজন অজানা ব্যক্তিকে টাকাটা দিয়েছিল স্যোশাল মিডিয়ার একটি ভাইরাল পোস্ট দেখে যেখানে গরীব এবং অসুস্থ একটি বাচ্চার চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তা চাওয়া হচ্ছিল।

রিপোর্ট করার পর দ্রুত থাই হোয়া শহরের পুলিশ নে অ্যান প্রদেশের সাইবার সিকিউরিটি এন্ড হাই-টেক প্রিভেন্টেশন বিভাগের সাথে সমন্বয় করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং স্যোশাল মিডিয়ার পোস্টগুলো যাচাই বাছাই শুরু করে। প্রাপ্ত তথ্য এবং প্রমাণের ভিত্তিতে দ্রুততার সাথে নে অ্যান প্রদেশের ডো লুং (Do Luong) জেলা থেকে পান ভান তাই (Phan Van Tai) নামক এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। পান ভান তাই একজন শ্রমিক হিসেবে বাখ নি প্রদেশে (Bac Ninh) প্রদেশে কাজ করতো। পুলিশ পান ভান তাই এর কাছ থেকে ২০০ মিলিয়ন নগদ ডং, ২টা মোবাইল এবং ৩টা ব্যাংক কার্ড উদ্ধার করে।

পান ভান তাই পুলিশের কাছে নিজেকে স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা অসুস্থ বাচ্চার পিতা বলে দাবি করে এবং সে অনেকগুলো স্যোশাল মিডিয়া একাউন্ট ব্যবহার করে ভুয়া সাহায্যের আবেদন করে। কিন্তু পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে অসুস্থ বাচ্চাটার বাবা পান ভান তাই নন।পুলিশের অনুসন্ধানে আরও জানা যায় পান ভান তাই ২০২১ সালের জুন মাস থেকে ভুয়া সাহায্যের আবেদন করে ১৬০০ জন মানুষকে ঠকিয়েছে এবং প্রায় ২৫৫ মিলিয়ন ভিয়েতনামি ডং হাতিয়ে নিয়েছে। এসব কারণে থাই হোয়া পুলিশ সন্দেহভাজন পান ভান তাইকে আরও তদন্তের জন্য আটক করে।

ভিয়েতনামে ভাইরাল হওয়া পোস্ট দেখুন এখানে।

 

স্যোশাল মিডিয়ায় ভুয়া সাহায্যের পোস্টের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ায় পান ভান তাইকে গ্রেফতার করার খবরটি সেই সময় ভিয়েতনামের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়। সেগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে পোস্টে থাকা অসুস্থ বাচ্চাটার পরিচয় কোথাও পাওয়া যায়নি।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাইরাল ফেসবুক পোস্টে একই শিশুর ছবি ব্যবহার করে সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে। এসব পোস্টেও শিশুটির নাম, বয়স ,স্থান বা অন্য কোনো পরিচয় না দিয়ে কেবলমাত্র ‘আমার মেয়ে’ কথাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। শিশুটির অসূস্থতার ধরন কি, বা সে কোন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে  সে তথ্য দেওয়া হয়নি এসব পোস্টে।

এখানে বিকাশে সাহায্য পাঠানোর জন্য যে ফোন নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে, (01798802072) সেই নাম্বারে ফোন করে দেখা গেল, নাম্বারটি খোলা রয়েছে, তবে একাধিকবার চেষ্টা করেও অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।

ফেসবুক সার্চের মাধ্যমে দেখা গেল,  01798802072 ফোন নাম্বারটি ভিন্ন বাচ্চার জন্য আর্থিক অনুদান তোলার কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পোস্টের ভাষা একই থাকলেও শিশুর ছবি ছিল ভিন্ন ।

এদের মধ্যে প্রথম ছবির শিশু (নাকে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে নলযুক্ত) কে  ভারতের ৩ বছর বয়স্ক ‘আশু সাইনি’ হিসেবে সনাক্ত করতে পেরেছে ফ্যাক্টওয়াচ। দ্বিতীয় ছবির শিশুটাকে ভারতের ৪ মাস বয়সী ‘রুবিনা’ হিসেবে সনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার। অর্থাৎ, এই শিশুদের কেউই বাংলাদেশী নয় ।

যে মোবাইল নাম্বারের সাহায্যে বিকাশে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে, ট্রু কলার এ্যাপ এর মাধ্যমে সেই ফোন নাম্বার ব্যবহারকারীর পরিচয় খোজার চেষ্টা করেছে ফ্যাক্টওয়াচ। দেখা যাচ্ছে, কোনো একজন ট্রু কলার ব্যবহারকারী 01798802072-এই নাম্বারটিকে ‘চিটার’ অর্থাৎ প্রতারক নাম দিয়ে সেভ করে রেখেছে।


সারমর্ম  


যে শিশুটির ছবি পোস্ট করে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে ঠিক একই ছবি ব্যবহার করে সাহায্যের আবেদন ভিয়েতনামের স্যোশাল মিডিয়ায় ২০২১ সালে ভাইরাল হয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনামের পুলিশের অনুসন্ধানে দেখা যায় এটা প্রতারণামূলক সাহায্যের পোস্ট যেটা পান ভান তাই নামক একজন ভিয়েতনামের নাগরিক করেছিলো। একারণে পান ভান তাইকে সেই সময় আটক করা হয়েছিলো। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এটা প্রমাণ হয় যে বর্তমানে বাংলাভাষায় ভাইরাল হওয়া সাহায্যের আবেদনের পোস্টটি ভুয়া। একারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

ফ্যাক্টওয়াচের সনাক্ত করা ভুয়া সাহায্যের আরো কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ,এখানে , এখানে , এখানে ,এখানে  ।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh