নিকোলা টেসলার আবিষ্কৃত প্রযুক্তি নিয়ে মনগড়া তথ্য

Published on: July 7, 2022

ফ্যাক্ট ফাইল

সম্প্রতি “নিজের যে সকল আবিষ্কার ধ্বংস করে ফেলেন নিকোলা টেসলা” ক্যাপশনে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে বলা হয়েছে, “নিকোলাস টেসলা এমন কিছু প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন যার সাহায্যে কোনো জলযানকে অদৃশ্য করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও তাঁর আবিষ্কৃত অন্য একটি প্রযুক্তির সাহায্যে সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলানো সম্ভব ছিল।”

ভিডিওটিতে প্রদত্ত তথ্য-উপাত্তের সুত্র ধরে ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান করে জেনেছে, এই ভিডিওতে যেসকল প্রযুক্তির কথা বলা হচ্ছে, টেসলা সেসকল প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন নি।

গুজবের উৎস:

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২১ তারিখে DN Arpon নামের ফেসবুক একাউন্ট থেকে এই গুজবটি ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ভিডিওটির শিরোনামে লেখা হয়, “নিজ হাতে যেসকল আবিষ্কার ধ্বংস করে ফেলেন বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা। উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকান নৌবাহিনীর জাহাজ অদৃশ্য করে শত্রুপক্ষের চোখের আড়ালে নিয়ে যাওয়া”। পরবর্তীতে ২৮ মার্চ ২০২২ তারিখে Durbin News নামক ফেসবুক পেজ থেকে আগের ভিডিওটি নতুনভাবে বানিয়ে প্রকাশ হয়।  Durbin News থেকে প্রকাশিত ভিডিওটি বর্তমানে ২০ লক্ষ মানুষের নজরে এসেছে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

ভিডিওটিতে দেয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাচাই করতে ফ্যাক্টওয়াচ নিকোলাস টেসলার উপরে লেখা একাধিক আন্তর্জাতিক প্রবন্ধ পড়ে জানতে পেরেছে ভিডিওটিতে প্রদত্ত এসকল তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই।

প্রথম দাবি -জাহাজ অদৃশ্য করা

ভিডিওটির শুরুর অংশে বলা হয়েছে, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিকোলাস টেসলার অধীনে টেলিপোরটেশন গবেষণার জন্য আমেরিকা আলবার্ট আইনস্টাইনকেও নিযুক্ত করেছিল। এ প্রযুক্তির সাহায্যে টেসলা ছোটো একটি জলযানকে অদৃশ্য করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন”।

প্রকৃতপক্ষে, ফিলাডেলফিয়া এক্সক্সপেরিমেন্ট নামক একটি কল্পিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার গুজব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গুজবে দাবি করা হয়, ১৯৪৩ সালের ২৮শে অক্টোবর আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়া নেভাল শিপ ইয়ার্ডে USS Eldridge নামক একটি জাহাজকে টেলিপোর্টেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অদৃশ্য করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

তবে, এই ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট বিজ্ঞানী এবং সাংবাদিক মহলে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy Theory) হিসেবেই পরিচিত। পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা যায়,  USS Eldridge জাহাজটি ওই দিনে (১৯৪৩ সালের ২৮শে অক্টোবর) বাহামা দ্বীপপুঞ্জে ছিল, সুতরাং তাকে ঘিরে পরীক্ষা চালানোর কো সুযোগ ই ছিল না। এছাড়া, যে প্রযুক্তির ( আইনস্টাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি)  সাহায্যে জাহাজকে অদৃশ্য করা সম্ভব বলে দাবি করা হয়, পদার্থবিজ্ঞানীরা বলছেন সেটা সম্ভব নয়।  আইনস্টাইন নিজেই কখনো এর ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখাতে পারেন নি, এমনকি এখন পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানীই তা পারেন নি।

যেহেতু, এই পরীক্ষা কখনো ঘটেই নি , তাই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা (Conspiracy Theorist) এই পরীক্ষার সাথে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর সম্পৃক্ততা জুড়ে দিয়ে গুজব ছড়ায়। আইনস্টাইন কিংবা টেসলা’র নাম এভাবেই যুক্ত হয়েছে এই পরীক্ষার সাথে।

নিকোলা টেসলা মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৯৪৩ সালের ৭ই জানুয়ারি। কাজেই, সে বছর ২৮শে অক্টোবর ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট ঘটে থাকলেও টেসলার সেখানে উপস্থিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

নিকোলাস টেসলা ও আলবার্ট আইনস্টাইন একসাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজ করেছিলেন কি না এব্যাপারে সার্চে ইঞ্জিনের উত্তর দেখে নেয়া যাক:

Quora থেকে প্রকাশিত উত্তর দেখুন এখানে

বিজ্ঞান ভিত্তিক বেস্ট সেলার লেখক Sam Kean এর প্রবন্ধ অনুযায়ী বিজ্ঞানী টেসলা মৃত্যুকালীন সময়ের কিছু বছর আগে থেকে তার শারীরিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে অর্থাৎ সেসময়ে নিকোলাস টেসলা শারীরিকভাবে প্রায় অক্ষম হয়ে হোটেল কক্ষে বন্দী একজন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সুতরাং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোনো প্রোজেক্টে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল না। বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়ে দেখা যায় নিকোলাস টেসলা ও আলবার্ট আইনস্টাইন একসাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজ করেছিলেন এমন কোনো তথ্যের ভিত্তি নেই। Science history institute থেকে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ুন এখানে।  স্ক্রিনশট দেখুন নিচে-

 

দ্বিতীয় দাবি- টাইডাল ওয়েভ

ভিডিওটির অন্য অংশে দাবি করা হয়েছে, নিকোলাস টেসলা আর্টিফিশিয়াল টাইডাল ওয়েব ব্যবহার করে সমুদ্রে কৃত্রিম ঢেউ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা দিয়ে যুদ্ধের সময় সহজেই শত্রুপক্ষের জলযানকে ডুবিয়ে দেয়া যেতো। তবে মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে তিনি এই যন্ত্রটিকে নিজ হাতে ধ্বংস করে দেন।

এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই।

লেখক এবং ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার ক্লেইন এর হিস্টোরি ডট কম এ লেখা এই নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, বিভিন্ন কাল্পনিক আবিষ্কার এর সাথে নিকোলা টেসলা এর নাম জড়ানো হয়, তবে এসব প্রযুক্তি টেসলা কখনো আবিষ্কার করেনি। এসব প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে কৃত্রিম টাইডাল ওয়েভ, কৃত্রিম ভূমিকম্প মেশিন, থট ক্যামেরা , ডেথ বিম ইত্যাদি।


তৃতীয় দাবি – ভূমিকম্প

এছাড়া ভিডিওটির শেষ অংশে দাবি করা হয়েছে, ১৮৯৩ সালে নিকোলাস টেসলা এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন যা দিয়ে রিখটার স্কেলে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প তৈরি করা সম্ভব ছিল, এই আবিষ্কারটির ক্ষমতা ছিল পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলার। যে কারণে তিনি এই যন্ত্রটিকে তিনি হাতুড়ির সাহায্যে ধ্বংস করে ফেলেছিলেন।

উল্লেখ্য, নিকোলা টেসলা প্রচুর যন্ত্র এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিলেন। আমেরিকার পেটেন্ট অফিসেই তার ১১২ টি পেটেন্ট ছিল। ইংল্যান্ড ,ফ্রান্স সহ বিভিন্ন দেশে আরো পেটেন্ট রয়েছে তার। কিন্তু এসব পেটেন্ট এর মধ্যে ভূমিকম্প মেশিন বা এই জাতীয় কোনো যন্ত্র এর কোনো উল্লেখ নেই।

এক নজরে তাঁর পেটেন্ট করা আবিষ্কারসমূহ দেখে নেওয়া যাক

১৮৯৩ সালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করে পৃথিবী ধ্বংস দেবার প্রযুক্তি আবিষ্কার বিষয়ে কোনো তথ্য আন্তর্জাতিক প্রবন্ধেও নেই। অর্থাৎ এই বিষয়টিও কাল্পনিক গল্প হিসেবে প্রচার হয়ে আসছে।


অন্যান্য দাবি

ভিডিও ক্যাপশনে নিকোলা টেসলাকে ‘বিজ্ঞানী’ হিসেবে অভিহিত করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কেবলমাত্র একজন উদ্ভাবক (Inventor)

যারা প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং কোনো তত্ত্ব (Theory) আবিষ্কার করেন, তাদেরকে বিজ্ঞানী বলে। আর যারা নিজেরা কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার করেন না, কিন্তু অন্যান্যদের তত্ত্ব ব্যবহার করে কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি তৈরি করেন, তাদেরকে উদ্ভাবক বলে।

অনেকে একইসাথে বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক হতে পারেন। যেমন স্যার আইজ্যাক নিউটন মাধ্যকার্ষণ তত্ত্ব ( Theory of Gravity) আবিষ্কার করেছেন, তাই তিনি বিজ্ঞানী। আবার তিনি রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ ও তৈরি করেছেন আলোর প্রতিফলনের সূত্র কাজে লাগিয়ে। এখানে, তিনি উদ্ভাবক।

নিকোলা টেসলা কোনো মৌলিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন নি । অন্য তত্ত্ব ব্যবহার করে প্রচুর যন্ত্র তৈরি করেছেন। তাই তাকে উদ্ভাবক বলা হয়।

সারমর্ম

সুতরাং ভাইরাল ভিডিওটি যে সকল তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে তা মূলত মনগড়া কাল্পনিক এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অংশ। বাস্তবিক কোনো প্রমাণ উক্ত ভিডিওটির সাথে সম্পৃক্ত নয়।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply