নেদারল্যান্ডসের স্কুলে গীতা পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হয়নি

Published on: [September 29,2021]

ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য গীতা অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে একটি পোস্ট ফেসবুকের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, নেদারল্যান্ডসে এমন কোনো আইন করা হয়নি। অতীতেও এই একই গুজব বিভিন্ন দেশে ভাইরাল হতে দেখা গিয়েছিল, যার কোনো সত্যতা কখনো পাওয়া যায়নি।

গুজবের উৎস

সাম্প্রতিককালে, গত ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে এমন কয়েকটি পোস্ট ফেসবুকে দেখা যেতে থাকে। তবে অতীতেও বিভিন্ন সময়ে একই পোস্ট ফেসবুকে দেখা গিয়েছিল। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

এসব পোস্টে বলা হয়েছে:

নেদারল্যাণ্ডের মোট জনসংখ্যা 1 কোটি 70 লক্ষ।

সেখানে হিন্দু মাত্র 2 লক্ষ 15 হাজার!

অথচ সরকার আইন প্রণয়ন করে পঞ্চম শ্রেনী থেকে “গীতা” পড়া বাধ্যতামূলক করলো!!

কারণ গীতা পরলে [পড়লে] মানসিক বিকাশ ঘটবে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

নেদারল্যান্ডসের সরকারী ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, চার বছর বয়সে একজন ডাচ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষালাভের উপযুক্ত বিবেচিত হয় এবং ৮ বছর সেখানে পড়াশুনা করে। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সরকারি স্কুল, বেসরকারি স্কুল, কমিউনিটি স্কুল সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্কুলভেদে  শিক্ষা কাঠামো ভিন্ন। সরকারি স্কুলে ধর্ম সম্পর্কিত কোনো বিষয় পড়ানো হয় না। তবে অধিকাংশ বেসরকারি স্কুলে (private school) এর সিলেবাসে ধর্ম-সম্পর্কিত বিষয় রাখা হয়।

সকল স্কুলেই কিছু আবশ্যকীয় বিষয় থাকে। নেদারল্যান্ডসের প্রাথমিক স্কুলে আবশ্যক বিষয়গুলো হল: ডাচ ভাষা, ইংরেজি ভাষা, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, রাজনীতি অধ্যয়ন, নাগরিকত্ব, রোড সেফটি,খেলাধূলা এবং সৃজনশীল কর্ম (গান, চিত্রাঙ্কন) ইত্যাদি । এসব বিষয়ের সিলেবাস এবং পাঠ্যবই সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ই ঠিক করে দিবে। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বই কিংবা সিলেবাস সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না।

দৈনিক শিক্ষা ডট কম এ প্রকাশিত ইউরোপ প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক কায়সুল খান এই নিবন্ধে নেদারল্যান্ড এর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন,  নেদারল্যান্ডে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ৫ বছর বয়স থেকে। যদিও কোন কোন স্কুলে ৪ বছর বয়সেই শিশুদের ভর্তি নেয়। ১৬ বছর বয়সের পর থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য ২ বছরের ঐচ্ছিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে । সপ্তাহে মাত্র ২ দিন স্কুলে যেতে হয়। বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণের বয়স ১৮ বছর। এ সময় শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা বা এইচএভিও কিংবা এমবিও লেভেল পাশ করার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে। পাবলিক স্কুল, ধর্মীয় স্কুল কিংবা নিউট্রাল স্কুলগুলো কিছু শর্ত পূরণ করে সরকারি আর্থিক সহায়তা লাভ করে। প্রাইভেট স্কুলগুলো যদিও নিজস্ব অর্থায়নের উপর নির্ভরশীল কিন্তু এদেশে এমন স্কুলের সংখ্যা খুব কম। স্পেশাল স্কুলগুলো একটি বিশেষ স্কুল বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। এ ধরনের স্কুলগুলো মূলত ধর্মীয় স্কুল। নেদারল্যান্ডে ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, ইহুদী এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা আলাদা স্কুল, হাই স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

এদেশে শিশুরা বুনিয়াদি স্কুলে শিক্ষা লাভ করে ৪ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। এগুলোকে বেসিস স্কুল বলে। ফাউন্ডেশন স্কুল ৮ম গ্রুপ (শ্রেণি) পর্যন্ত। ২য় গ্রুপ পর্যন্ত শিশুদের জন্য ক্লাসে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ব্যবস্থা আছে। বেসিস স্কুলগুলোতে শিশুরা গ্রুপ ৩-তে উঠলে তাদের পড়া, লেখা ও গণিতে দক্ষতার পাঠ দেয়া হয়। অধিকাংশ স্কুলে ইংরেজির পাঠ দেয়া হয় শিশুরা গ্রুপ ৭-এ উঠলে। তবে কিছু কিছু স্কুলে গ্রুপ ১ থেকেই ইংরেজি শেখানোর চল রয়েছে। শিক্ষার্থীরা গ্রুপ ৮-এ উঠলে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ টেস্ট ডেভেলপমেন্টের অধীনে একটি অ্যাপটিটিউট টেস্ট গ্রহণ করা হয়। এটাকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বা সিটো টেস্ট বলে। অবশ্য সিটো টেস্ট শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। কিছু স্কুল এর বদলে নিজস্বভাবে স্কুল ফাইনাল টেস্ট নিয়ে থাকে।

কাজেই , গীতা, কিংবা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মসম্পর্কিত বই নেদারল্যান্ডস-এর সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক করার সুযোগ নেদারল্যান্ডসের বিদ্যমান আইনে দেখা যাচ্ছে না।

নেদারল্যান্ডসের হিন্দু সম্প্রদায়

The Hindu Perspective ওয়েবসাইটে ২০১৩ সালে প্রকাশিত (এবং ২০০৬ সালে লিখিত) এই নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, নেদারল্যান্ডে প্রায় ২ লাখ হিন্দু বসবাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারের বসবাস নেদারল্যান্ডের রাজধানী হেগ এ। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত ৫ টি  হিন্দু স্কুল রয়েছে দেশব্যাপী। এই স্কুলগুলো হিন্দু কমিউনিটি দিয়েই পরিচালিত হলেও ‘সরকারি’ স্কুল হিসেবে পরিচিত , এবং দেশের অন্য স্কুলগুলোর মত একই পাঠসূচী অনুসরণ করে। সরকারী পাঠ্যসূচী ছাড়াও, এসব স্কুলে হিন্দি ভাষা এবং রামায়ন,মহাভারত পড়ানো হয়।   স্কুলে যে কোনো ধর্মের নাগরিকই পড়তে পারে। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৭%-৯৮% হিন্দু এবং ২%-৩% অন্য ধর্মাবলম্বী রয়েছে।

নিউজগ্রাম নামক অন্য একটি ওয়েবসাইটে Thi Hindu Evolution in Holland শীর্ষক ২০১৫ সালে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, নেদারল্যান্ডসে এখন ৫ টি হিন্দু স্কুল রয়েছে । এগুলো স্থানীয় হিন্দু কমিউনিটি দ্বারা পরিচালিত এবং ‘জাতীয় স্কুল’ হিসেবে গণ্য। (There are five Hindu schools funded by the Hindu community in the country, which are deemed as national school) এসব স্কুলে হিন্দি ভাষা শেখানো , রামায়ন, মহাভারত পড়ানো এবং বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় পূজা-পার্বণ উদযাপন করা হলেও জাতীয় পাঠক্রম মেনে চলা হয়। গীতা যেহেতু মহাভারতেরই অংশ, ফলে এই পাঁচটি স্কুলে গীতা পড়ানো হয় এটা বলা যায়।

ছবির সত্যতা যাচাই

পোস্টের সাথে যে ছবিগুলো যোগ করা হয়েছে, তার কোনোটাই ডাচ শিশুদের গীতা অধ্যয়নের ছবি নয়।

গীতা হাতে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমের একটি মাত্র ছবি রয়েছে, তবে সেখানে সকল ভারতীয় শিশুদের দেখা যাচ্ছে । ক্লাসরুমের আদলের সাথে নেদারল্যান্ডসের কোনো ক্লাসরুমের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। বরং কোনো ভারতীয় অনুষ্ঠানের দৃশ্যের সাথে অনেকটাই মিলে যায় ছবিটি।

তাছাড়া, অনলাইনে এই ছবিটা ২০১৯ সালেও দেখা গিয়েছে। সেই পোস্টে এই ছবিটাকে নেদারল্যান্ডসের বিদ্যালয়ের ছবি বলে দাবি করা হয়নি।

অপর একটি ছবিকে আমেরিকার ছবি বলে চিহ্নিত করা গেছে।

১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস এবং ইসকন এর আমেরিকার সাথে সম্পর্ক নিয়ে ব্যাক টু গুডহেড ডট কমে প্রকাশিত Krishna Consciousness: The Spirit of ’76! নিবন্ধে এই ছবিটা পাওয়া গেল।

অন্য যে ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো কোনো পাবলিক ডোমেইনে খুঁজে পাওয়া গেল না।


অন্যান্য ফ্যাক্টচেকারদের অনুসন্ধান ,

নেদারল্যান্ডসে গীতা বাধ্যতামূলক করার দাবিটি অনেক পুরনো। ভারতে অতীতে বিভিন্ন সময়ে এই দাবিটি ভাইরাল হয়েছিল। ভারতের  বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা এই দাবিটি খতিয়ে দেখে জানিয়েছে, এই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। দাবিটি সম্পূর্ণ ভুয়া। এমন কিছু ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট দেখুন ভারতের অল্ট নিউজ , নিউজমিটার , নিউজ মোবাইল , সোস্যাল মিডিয়া হোক্স স্লেয়ার এর ইংরেজি ভার্সনে এবং বুম ইন্ডিয়ার বাংলা ভার্সনে

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

নেদারল্যান্ডের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে গীতা অধ্যয়নের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচটি হিন্দু স্কুলে রামায়ণ-মহাভারত পড়ানো হয় যেহেতু, মহাভারতের অংশ হিসেবে গীতা পড়ানো হতে পারে। কিন্তু এর বাইরে, নেদারল্যান্ডসের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এরকম সুযোগ নেই নেই। সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply