গরিলা আকৃতির মাছের ছবিটি বিকৃত

Published on: May 3, 2023

সমুদ্রে ধরা পড়ল গরিলা মুখাকৃতি বিরল প্রজাতির মাছ এমন ক্যাপশনযুক্ত একটি খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই খবরে দাবি করা হচ্ছে, সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি একটি বিশাল মাছ ধরেছে সমুদ্র থেকে, যা দেখতে অবিকল গরিলার মতো। খবরের সাথে একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই ছবিটা এডিটেড। “আলজেরিয়ান গরিলা ফিশ” নামেও কোনো মাছ প্রাণিজগতে খুঁজে পাওয়া যায় নি। 

গুজবের উৎস

ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

মূলত দু’টি অনলাইন পোর্টাল, bengalstep এবং infobidz এর মাধ্যমে বাংলা ভাষায় এই গুজবটা ছড়িয়ে পড়ছে।

বেঙ্গল স্টেপ পোর্টালে প্রকাশিত এই নিবন্ধে বলা হয়েছে,  সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি একটি বিশাল মাছ ধরেছে সমুদ্র থেকে, যা দেখতে অবিকল গরিলার মতো। অর্থাৎ প্রাণীটির শরীর মাছের মতো কিন্তু মুখটি দৈত্যাকার গরিলার মতো।এই ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসা মাত্রই অবাক করেছে সকলকে।

এমতাবস্থায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, ছবিটি ভুয়ো, এডিটিং-এর মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। প্রাণীটির নাম দেওয়া হয়েছে- আলজেরিয়ান গরিলা মাছ। পোস্টটি ভাইরাল হওয়া মাত্রই দারুণ ভিড় জমেছে সেই ছবির মন্তব্য বক্সে। একজন ব্যক্তি লিখেছেন যে, এটি একটি আলজেরিয়ান গরিলা মাছ, যা একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। এটি সাধারণত ৩-৪ ফুট হয়। হয়তো এই প্রাণীটির খাদ্য একটি তিমির বাচ্চা হওয়ার কারণে এর শরীরের মারাত্মক আকারে বেড়ে গিয়েছে।

এই প্রাণীটি প্রায় ৩৪টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। সঙ্গমের সময়ে এহেন মহিলা প্রাণীরা দেখতে উজ্জ্বল লাল হয়ে যায়। এরা প্রায় ৪৮ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। যা কিনা অত্যন্ত বিরল। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এই পোস্টটি কতটা সত্যতা তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু তার পোস্টে থাকা ব্যক্তিটি এই প্রাণী টিকে আলজেরিয়ান গরিলা মাছ বলেছেন। অনেক ব্যবহারকারীদের মধ্যে একজন লিখেছেন, এই মাছটি দেখতে বেশ দর্শনীয়।

অর্থাৎ ,দেখা যাচ্ছে, খবরের বিস্তারিত অংশে জানানো হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এই পোস্টটি কতটা সত্যতা তা বলা সম্ভব নয় । কিন্তু এই সংশয়ের কথাটি খবরের শিরোনামে, কিংবা ফেসবুক পোস্টের ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে পাঠক সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে।

আন্তর্জাতিকভাবেও কথিত ‘আলজেরিয়া গরিলা ফিশ’ এর এই ছবিটি ভাইরাল হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে স্পোর্টস কীড়া , দ্য সান , ডেইলি স্টার সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। প্রত্যেকেই এই ছবিটাকে এডিটেড মর্মে রায় দিয়েছে।

একটি সীল মাছ, একটি সিলাকান্থ (coelacanth) মাছ এবং একটি গরিলার সমন্বয়ে এই ছবিটা তৈরি করা হয়েছে বলে স্পোর্টসকীড়ার এই নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে।

ইংল্যান্ডভিত্তিক ট্যাবলয়েড ডেইলি স্টার জানাচ্ছে, মিয়ামির পশু বিশেষজ্ঞ মাইক হোলস্টন এই গুজবকে ভাইরাল করেছেন। তিনি তার ভেরিফাইড ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট থেকে গত ২০শে এপ্রিল এই প্রাণীর ছবিটি পোস্ট করে ক্যাপশনে বিভিন্ন মনগড়া তথ্য লিখেছেন। প্রাণীটার আয়ুষ্কাল সম্পর্কে তিনি দাবি করেন, সাধারণত এটা সর্বোচ্চ ১৩ বছর বাচতে পারে,কিন্তু খতনা করানো হলে এটা সর্বোচ্চ ৪৮ বছর পর্যন্ত বাচতে পারে ( they can live up to 13 years old but if they are circumcised they can live up to 48!)

স্পষ্টতই এটা ছিল একটা স্যাটায়ার বা রসিকতা, তবে এই রসিকতা ধরতে না পেরে অনেক সংবাদমাধ্যমই আলজেরিয়ান গরিলা ফিশ এর সর্বোচ্চ আয়ুষ্কাল ৪৮ বছর হিসেবে তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।

এই ইনস্টাগ্রাম পোস্টে আরো দাবি করা হয়েছে, এই মাছেরা দলবেঁধে সেপ্টেম্বর মাসে ঘোরাঘুরি করে, যখন এল নিনো সর্বোচ্চ গতিতে থাকে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সাগরের পানির তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রবণতাকে এল নিনো বলে । এর কোনো নিয়মিত শিডিউল নেই। সাধারণত প্রতি ৩ থেকে ৫ বছরে একবার এল নিনো ঘটে। একবার এল নিনো শুরু হলে ৯ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত চলে। সাধারণত এটা মার্চ মাসে শুরু হয় এবং নভেম্বর-ডিসেম্বরে এর সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে।

অর্থাৎ, এল নিনোর সাথে বেগ এর কোনো সম্পর্ক নেই, এবং সেপ্টেম্বর মাসেও এর সর্বোচ্চ প্রকাশ এর কোনো প্রমাণ নেই। অর্থাৎ মাইক হলস্টন এর দেওয়া এই তথ্যটাও আরেকটি রসিকতা।

ইমেজ সার্চের সাহায্যে এডিট করা ছবির মূল ভার্সন ফ্যাক্টওয়াচ খুজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্ভবত, নীল গেঞ্জি পরিহিত ব্যক্তিটি অন্য কোনো মাছ ধরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন। তাঁর হাতের সেই ছবিটি পরিবর্তন করে গরিলা ফিশ এর ছবিটা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিশালাকৃতি মাছের সাথে জেলেদের অন্যান্য ছবি তুলনা করলে আলোচ্য গরিলা ফিশের এই ছবির বেশ কিছু অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে। যেমন, এখানে জেলেটি দুই হাত দিয়ে কিভাবে এত ভারি মাছটি ধরে রেখেছে, সেটা পরিষ্কার নয়। মাছটি কিভাবে শুধু লেজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। এছাড়া,মাছটির মুখ এবং চোখ খোলা ,যা দেখে তাকে জ্যান্ত মাছ বলেই মনে হচ্ছে। এমন ধারালো দাঁতবিশিষ্ট জ্যান্ত একটি মাংসাশী মাছের এত কাছে একজন জেলে কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কিভাবে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, সেটাও প্রশ্নের উদ্রেক করে। তবে এডিটেড ফটোতে এ সবই সম্ভব।

 

আলজেরিয়ান গরিলা ফিশ, গরিলা ফিশ বা এই জাতীয় বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড সার্চ করেও বিশ্বের কোথাও এমন ধরনের কোনো প্রাণি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সার্বিক বিবেচনায় ছড়িয়ে পড়া ফেসবুক পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ মর্মে রায় দিচ্ছে।

আরো পড়ুন – জলপরীর এই ভিডিওটি কম্পিউটার এনিমেশন প্রযুক্তি দিয়ে বানানো

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh