সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ডে পানি ব্যবহার কি ঠিক ছিল ?

Published on: July 1, 2022

Fact File

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং আগুন নেভাতে পানির ব্যবহারকে কেন্দ্র করে অনলাইনে বিতর্ক তৈরি হয়েছে । অনেকে দাবি করছেন পানি ব্যবহারের ফলেই বিস্ফোরণ আরো বেড়েছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, এই ধরনের আগুনে ফায়ার এক্সটিংগুইশারের ফোম এর বদলে পানি ব্যবহার করাই উচিত। 

গুজবের উৎস

গত ৫ই জুন থেকে সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র ফেসবুকে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়। ভাইরাল ফেসবুক পোস্টে “হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে চট্টগ্রামে আগুনের সুত্রপাত।তথ্যের অভাবে পানি ব্যবহারের ফলে ভয়াবহ বিস্ফোরন আরো বেড়েছে” শিরোনাম সহ বিভিন্ন শিরোনামে কখনো শুধু টেক্সট ব্যবহার করে, কখনো ছবি বা ভিডিও জুড়ে দিয়ে পোস্ট করা হচ্ছে। ভাইরাল পোস্টের মূল দাবি হচ্ছে পানি ব্যবহারের ফলেই সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ আরো বেড়েছে।

এমনই কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।


 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

ভাইরাল হওয়া পোস্টটিকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হওয়ায় ফ্যাক্ট-ওয়াচ অনুসন্ধান শুরু করে।

উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে, হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ যার সংকেত হল H2O2। বিশুদ্ধ অবস্থায় এটি বর্ণহীন তরল, জলের থেকে এর সান্দ্রতা সামান্য বেশি। নিরাপত্তাজনিত কারণে সব সময় এটির জলীয় দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। H2O2 হলো সব থেকে সরল পারক্সাইড (যে যৌগে অক্সিজেন-অক্সিজেন একক বন্ধন থাকে) এবং এটি একটি শক্তিশালী জারক ও বিরঞ্জক যৌগ। গাঢ় H2O2 কে রকেটের জ্বালানীতে প্রোপেল্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আলোর উপস্থিতিতে এটি বিযোজিত হয়ে পানি এবং অক্সিজেন উতপন্ন করে, এ কারনে সাধারনত একে কোনো আলোহীন পাত্রে ঢেকে রাখা হয়।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এ আগুন লাগলে কিভাবে নেভাতে হবে ?

আগুনের জন্য তিনটা জিনিস লাগে—তাপ , জ্বালানী, অক্সিজেন। এই ৩ টাকে একত্রে ফায়ার ট্রায়াংগল (আগুনের ত্রিভুজ) বলে।

তিনটার যে কোন একটা বন্ধ করে ফেললে আগুন নিভে যায়।

কাঠ,কাগজ বা গৃহস্থালি আগুনে পানি দিয়েই আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়। এক্ষেত্রে পানি তাপমাত্রা কমিয়ে আগুন নেভানোর মূল কাজ করে।

তবে অনেক রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক লাইনের ক্ষেত্রে পানি ব্যবহারে ক্ষতি হতে পারে। ইলেক্ট্রিক লাইনে পানি বরং আরো বৈদ্যুতিক স্পার্ক এর সূচনা করতে পারে। বিভিন্ন রাসায়নিক পানির সাথে বিক্রিয়া করে আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

এ কারনে সাধারণ রাসায়নিক আগুনে ফোম বা অন্য রাসায়নিক যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে বাতাসের অক্সিজেনের পথ বন্ধ করা হয়, ফলে আগুন নিভে যায়।

কোন ধরনের আগুনে কি দিয়ে পানি নেভাতে হবে, তার উপর ভিত্তি করে আগুনকে A , B, C, D ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এর ক্ষেত্রে পানি , নাকি ফোম ব্যবহার করা উচিত, এটাই ছিল নেটিজেনদের বিতর্কের মূল বিষয়।

হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এর ক্ষেত্রে , একে কার্বন ডাই অক্সাইড কিংবা এমোনিয়াম বাই সালফেট এর ফোম দিয়ে আবৃত করে দিলে, বাইরে থেকে অক্সিজেন আসা ব্যহত হবে। কিন্তু H2O2 নিজেই বিযোজিত হয়ে অক্সিজেন উৎপন্ন করতে পারে। বিক্রিয়াটি নিম্নরূপ-

2 H2O2 → 2 H2O + O2

উচ্চ তাপমাত্রায় এই বিয়োজনের হার দ্রুত হয়। ফলে , এই আগুনে ফোম দিলেও অক্সিজেনের প্রবাহ বন্ধ হবে না। আর অক্সিজেন বন্ধ না হওয়ার ফলে আগুন নিভবে না ।

তবে এখানে পানি দিলে দুইটা কাজ হবে—তাপমাত্রা কমতে থাকবে, এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ঘনত্ব কমতে থাকবে, ফলে অক্সিজেনের সরবরাহ কমতে থাকবে। ফলে এক সময় আগুন নিভে যাবে।

Safety Data Sheet

রপ্তানিযোগ্য প্রতিটা রাসায়নিক পণ্যের জন্য কিছু কাগজপত্র দরকার হয়, যারা TDS (Technical Data Sheet) , SDS (Safety Data Sheet) , MSDS (Material Safety Data Sheet) ইত্যাদি নামে পরিচিত । এসব কাগজপত্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সকল রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানই এগুলো মেনে চলে । এই SDS এ ১৬ টা সেকশন থাকে, যেখানে এই রাসায়নিক পদার্থের নাম, রাসায়নিক ফর্মূলা, উপাদান, ব্যবহারবিধি, পরিবহন, সংরক্ষণ সহ যাবতীয় তথ্য দেওয়া থাকে।

১৬টা সেকশন এর মধ্যে ৫ নাম্বার সেকশন এর নাম Fire-Fighting Measures , অর্থাৎ ,উক্ত রাসায়নিক পদার্থে আগুন লাগলে কি করতে হবে, সে সংক্রান্ত দিক নির্দেশনা দেওয়া থাকে।

নিউজ বাংলার এই প্রতিবেদন থেকে ঘটনাস্থলে আল-রাজি কেমিকাল কমপ্লেক্স এর উৎপাদন করা ৫০% হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এর উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।


অনলাইনে খোঁজাখুঁজি করে আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স এর উৎপাদিত ৫০% হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এর সেফটি ডাটা শিট কোনো পাবলিক ডোমেইনে খুজে পাওয়া যায়নি।

তবে অন্যান্য বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদন করা একই রাসায়নিক পদার্থের সেফটি ডাটা শিট পাওয়া গিয়েছে।

যেমন- United-initiators -এর ৫০% হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের সেফটি ডাটা শিটে কেবলমাত্র পানিই ব্যবহার করতে বলা হয়েছে । অন্য কোনো অগ্নি-নির্বাপক ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।

ডাটা শিটটি দেখুন এখানে-

আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন করা  ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডাটা শিট ( MSDS -Material Safety Data Sheet) এও পানি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।  যেমন দেখুন –এখানে, এখানে


আন্তর্জাতিক গাইডলাইন

United States Department of Agriculture নিয়ন্ত্রণাধীন FOREST PRODUCTS LABORATORY এর সরকারি ওয়েবসাইটের এই নীতিমালায় হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরণে পানির ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয় “In case of fire, use only water. Deluge with large quantities. Foam is not effective because oxygen and heat continue to be generated under the foam blanket.”

যার বাংলা ভাবানুবাদ করলে হয় “ আগুনের ঘটনায় শুধু পানি ব্যবহার করতে হবে। অনেক বেশি পরিমাণে। এখানে ফোম কার্যকারি না কারণ অক্সিজেন এবং তাপ ফোমের আবরণের নিচে তৈরি হতে থাকে।”



অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ায় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহারের এই নীতিমালায় বলা হয়েছে ,

Flood with water to extinguish fire (আগুন নেভাতে বণ্যার মত প্রচুর পানি ঢালুন)।

নিউ জার্সির স্টেট গভার্নমেন্টের ওয়েবসাইটের এই নিবন্ধে বিপুল পরিমাণ  পানির ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড জ্বলনশীল নয়। কিন্তু এটা একটা শক্তিশালি অক্সিডাইজার (যে উপাদান নিজে অক্সিজেন উৎপাদন করে) যা অন্য উপাদানগুলোর জ্বলনশীলতা বাড়াতে পারে। তাছাড়া আরো বলা হয়েছে আগুনে কন্টেইনার বিস্ফোরিত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞ মতামত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ হাসান বলেন, ‘পানি দিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের আগুন নেভানো যাবে না—এটা সঠিক নয়। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের নিজের দাহ্যতা না থাকলেও যথেষ্ট পরিমাণ দাহ্য অবস্থা তৈরি করতে পারে। কিন্তু এটিকে পানি দিয়েই নেভাতে হয়। সেখানে এত বেশি পরিমাণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল, যার কারণে পানি দিয়ে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।

প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে-

 

প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞান লেখক  জাভেদ ইকবাল তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করছেন পানি দিয়ে আগুন নেভানো সঠিক ছিলো।

তিনি তার পোস্টে দাবি করেন “হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের আগুন নেভানোর জন্য পানিই সঠিক অগ্নিনির্বাপক।  হাইড্রোজেন পারক্সাইডের আগুন তেলের আগুন না, ইলেকট্রিকাল আগুন না। এটা নেভাতে পানিই ব্যবহার করা লাগে। ফোম অগ্নিনির্বাপক, যা তেলের আগুনে ব্যবহার করা যায়, সেটা এখানে কোন উপকার করবে না, কারন দহনের মূল উপাদান, অক্সিজেনের সরবরাহ হাইড্রোজেন পারক্সাইড থেকেই আসবে।”

জাভেদ ইকবালের পোস্টটি দেখুন এখানে

সীতাকুণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে করা THE BUSINESS STANDARD এর রিপোর্টেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিপুল পরিমাণ পানি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে-

সারমর্ম

দেশের এবং দেশের বাইরের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এর ফলে সৃষ্ট আগুনকে পানি ব্যবহার করেই নেভানোর চেষ্টা করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডাটা শিটেও সেই তথ্য পাওয়া গেল। তাই ফ্যাক্টওয়াচ  ‘ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের আগুনে পানি ব্যবহার করা উচিত নয়’ – এই দাবিটিকে নাকচ করে দিচ্ছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply