Published on: June 3, 2024
ফেসবুকের থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকাররা কী করেন? ফ্যাক্টচেকাররা যখন ফ্যাক্টচেক করে কোনো প্রচারিত তথ্য মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিমূলক এমন প্রমাণ পান, তখন সেটা তারা একটা প্রতিবেদন আকারে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। সেখানে তারা প্রমাণ দেন, কেন সেই তথ্যটি মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিমূলক। কোনো তথ্যকে মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিকর আখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে।
“ফ্যাক্ট চেকাররা কীভাবে কাজ করেন” এই শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোতে ৩ জুন ২০২৪ এ প্রকাশিত সুমন রহমানের নিবন্ধটি ফ্যাক্টওয়াচের ওয়েবসাইটে পুনরায় প্রকাশ করা হল। |
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মেটা সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের ১৪৮ টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং পেজ ফেসবুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে। মেটার এ বছরের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসবের মাধ্যমে বিএনপির বিরূদ্ধে প্রচারণা চালানো হত।
এই বিষয়টির ওপর লেখা প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা গত ৩১ মে ২০২৪ লিখেছে, গুজব ঠেকাতে ফেসবুক সারা বিশ্বে ৯০টি সংস্থার সাথে কাজ করে। বাংলাদেশে তারা কাজ করে ফ্যাক্টওয়াচ, বুম এবং এএফপির সাথে। এর পরপরই লিখেছে, “গুজব ছড়ানো কনটেন্টের পাশাপাশি যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে গুজব ছড়ানো হয়, সেগুলোও ডিলিট করা হয় বলে তখন বলেছে মেটা”।
বিবিসি বাংলার এই মন্তব্যে বিভ্রান্তির অবকাশ থেকে যায়। এ থেকে অনেকেই ধরে নিতে পারেন, গুজব ছড়ালেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা হয়! আবার অনেকে ভাবতে পারেন, ফেসবুকের সাথে কাজ করা ফ্যাক্টচেকাররা হয়ত কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন!
এই দুই ধারণার কোনটাই সঠিক নয়।
ফ্যাক্টচেকাররা আসলে কী করে? মেটার সাথে কাজ করা “থার্ড পার্টি” ফ্যাক্টচেকাররাই বা কিভাবে কাজ করে? বিষয়টা সংক্ষেপে খোলাসা করা যাক।
ফ্যাক্টচেকিং মানে তথ্য যাচাই। যে কোনো সংবাদমাধ্যমই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তথ্য যাচাই করে। সরেজমিন তদন্ত করে। কিন্তু এর সাথে ফ্যাক্টচেকিং প্রক্রিয়ার ফারাক আছে। ফ্যাক্টচেকাররা সাধারণত কোনো সরেজমিন তদন্ত করেন না, অর্থাত্ প্রাইমারি ডাটা সংগ্রহ করেন না । ব্যক্তিবিশেষের মৌখিক সাক্ষ্যকেও তারা সাধারণত প্রমাণ হিসেবে নেন না। জনপরিসরে থাকা কোনো তথ্য সঠিক কিনা, তারা তা যাচাই করেন সেকেণ্ডারি ডাটা অর্থাত্ জনপরিসরে থাকা অপরাপর তথ্যের সাপেক্ষে। কোনো গোপনীয় তদন্ত, সাক্ষ্য, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত – এসব দিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চলে, কিন্তু ফ্যাক্টচেকিং নয়।
ফেসবুকের থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকাররা কী করেন? ফ্যাক্টচেকাররা যখন ফ্যাক্টচেক করে কোনো প্রচারিত তথ্য মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিমূলক এমন প্রমাণ পান, তখন সেটা তারা একটা প্রতিবেদন আকারে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। সেখানে তারা প্রমাণ দেন, কেন সেই তথ্যটি মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিমূলক। কোনো তথ্যকে মিথ্যা, বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিকর আখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। মোটাদাগে, একটা তথ্যের কোনোরকম ভিত্তি না থাকলে তাকে ফ্যাক্টচেকাররা “মিথ্যা” তথ্য বলেন। কোনো ছবি বা পোস্টারের ছবি বা বক্তব্যকে যখন ফটোশপজাতীয় টুলস দিয়ে বদলে দেয়া হয়, তাকে ফ্যাক্টচেকাররা “বিকৃত” আখ্যায়িত করেন, আবার কোনো তথ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এমনভাবে যদি কেউ ব্যবহার করেন যে, তার অর্থ পাল্টে যায়, সেটাকে তারা সাধারণত “বিভ্রান্তিকর” বলে থাকেন। যাই হোক, মেটার সাথে চুক্তিবদ্ধ থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকাররা তাদের লেখা প্রতিবেদনে সেসব অসত্য তথ্যের কিছু ফেসবুক লিংক দিয়ে রাখেন। ফেসবুক মূলত নিজ প্লাটফর্মে থাকা সেসব লিংকগুলোকে “মিথ্যা”, “বিকৃত” কিংবা “বিভ্রান্তিকর” এভাবে রেট করে। অর্থাত্, পরবর্তীতে ফেসবুকে থাকা এসব অসত্য তথ্যের সাথে এর সত্যাসত্য বিষয়ক রেটিংও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা দেখতে পাবেন। ফেসবুক সেখানে পরিষ্কারভাবে লিখে দেয়, তাদের স্বাধীন থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেকাররা বলছে এই তথ্যটি সঠিক নয়(মিথ্যা /বিভ্রান্তিকর/বিকৃত ইত্যাদি)। তার নিচে তারা ফ্যাক্টচেকারদের ঐ বিষয়ে লিখিত প্রতিবেদনের একটা লিংকও দিয়ে দেয়। নিচের ছবিদুটো থেকে বিষয়টি বোঝা যাবে:
থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকারদের রেট করা অসত্য পোস্ট প্রথম ছবিটার মত দেখাবে। পুরোপুরি মিথ্যা রেট হলে অবশ্য পুরো পোস্টটাকেই ঢেকে দেয়া হয়। প্রযোজ্য রেটিংটার নিচেই লেখা থাকে See why। অর্থাত্ আপনি ওখানে ক্লিক করলে দ্বিতীয় ছবিটি দেখতে পাবেন। সেখানে রেটিং এর ব্যাখ্যা দেয়ার পাশাপাশি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদনটারও লিংক দেয়া আছে। অর্থাত্ আপনি এখানে গেলে পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে পারবেন।
কোন ফেসবুক পোস্ট যদি থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকাররা অসত্য বলে চিহ্নিত করেন, তখন তার রিচ বা সার্কুলেশন খুবই কমে যায়। কিন্তু পোস্টটি থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেকারদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফেসবুক থেকে সরিয়ে দেয়া হয় না। বরং সেসব তথ্য সংশোধন করা সাপেক্ষে ফ্যাক্টচেকাররা ঐ পোস্ট থেকে রেট উঠিয়ে দেন। সেইসাথে, ঐ পোস্ট-প্রণেতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের সার্কুলেশন বা রিচও ফেরত পান। অ্যাকাউন্ট ডিলিট করা কিংবা পোস্ট সরিয়ে দেয়ার মত অ্যাকশন নেয়ার ক্ষেত্রে ফেসবুক থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকারদের ব্যবহার করে না। এজন্য হয়ত তাদের অন্য কৌশল বা এজেন্সি আছে। কিন্তু বিবিসি বাংলার ঐ প্রতিবেদন পড়লে মনে হবে যেন ফ্যাক্টচেকারদের মাধ্যমেই ফেসবুক এই কাজটি করে থাকে!
ফ্যাক্টচেকাররা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে কিনা, সেটা তদারক করে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) নামে একটি সংস্থা। আইএফসিএন-এর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা কোড অব প্রিন্সিপল রয়েছে। আইএফসিএন এর নীতিমালা অনুযায়ী, ফ্যাক্টচেকারকে হতে হবে স্বাধীন, যে কোনো ধরনের পক্ষপাত থেকে মুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, পদ্ধতিগত এবং ভ্রান্তিহীন। একটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আইএফসিএন একটি ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাকে যাচাই বাছাই করে তার সিগনেটরি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। প্রতি বছর একই যাচাই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ঐ ফ্যাক্টচেকিং সংস্থাকে তার কার্যকারিতা এবং নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়ে সদস্যপদ নবায়ন করতে হয়। ফ্যাক্টচেকিং সংস্থামাত্রই জানে, এই নবায়ন প্রক্রিয়া কতখানি চ্যালেঞ্জিং!
মেটার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ১৪৮টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং পেজ সরিয়ে দেয়ার যে তথ্য উঠে এসেছে, তার সাথে ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। ফ্যাক্টচেকাররা জনপরিসরে থাকা উপাত্তের সাপেক্ষে কোনো দাবিকে যাচাই করতে পারে কেবল। আর সেই যাচাই প্রক্রিয়াটিও ঘটে জনপরিসরে, কোনো গোপনীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে নয়।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ |