আইসিউতে মৃত রোগীর বগলে গরুর ইনজেকশন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার তথ্যটি গুজব

Published on: December 27, 2021

ICU-তে মৃত রোগীর বাম বগলে গরুকে ইনজেকশন দেওয়ার সিরিঞ্জ পুশ করে জীবিত দেখানো হয় – এমন একটি খবর ফেসবুকে পাওয়া যায়। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে এটি সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। এটি সাধারণ মানুষের মেডিকেল জ্ঞানের অভাব এবং বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ব্যবসা নিয়ে জনমনে সৃষ্ট নেতিবাচক ধারণার সুযোগ নিয়ে তৈরি হওয়া একটি গুজব।

গুজবের উৎস

ফেসবুকে গুজবটির সবচেয়ে পুরনো সূত্র হিসেবে পাওয়া যায় ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি ডাক্তার তানিয়া সুলতানা নামক পেইজ থেকে করা পোস্ট। তবে আদতে এটি কোনো ডিগ্রিধারী পেশাদার ডাক্তারের পেইজ নয়।

তখন থেকে গুজবটি ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাল হয়েছে। গুজবটি পোস্ট, ছবি এবং ভিডিও আকারে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি নতুন করে কিছু পেজ, প্রোফাইল ও গ্রুপে এটি পুনরায় ভাইরাল হচ্ছে। এরকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানেএখানে, এখানেএখানেএখানে, এবং এখানে।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন ডাক্তারের নাম সম্বলিত এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পেইজ ও গ্রুপ থেকেও এ পোস্টটি শেয়ার করা হয়েছে।




ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

অনুসন্ধান করে ফ্যাক্টওয়াচ দেখতে পায় দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিন ৮ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখ ‘আইসিইউতে লাশ নিয়ে ব্যবসা’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে উল্লেখ করা হয় জনৈক ডাঃ আরিফা জাহান নামক একজন ফেসবুকে এই তথ্যটি দিয়েছেন। তবে ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে এই পোস্ট অথবা ডাঃ আরিফা জাহান নামে কোনো প্রোফাইল বা পেইজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় নি।


উল্লেখ্য, ১৪ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার গুজবটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত হয়েছিল, যা তারা পরবর্তীতে ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলে।

ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত CKD Urology Hospital-এ কর্মরত আইসিইউ স্পেশালিস্ট Dr Md Sirajul Islam ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি তার ইউটিউব চ্যানেলে গুজবটি নিয়ে একটি ভিডিওবার্তা প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি আইসিইউতে থাকা একজন রোগীর ক্যাথেটার, টিউব পরানো সংক্রান্ত ব্যাখ্যা দেন। তিনি দাবি করেন একজন মৃত রোগীকে দিনের পর দিন আইসিইউ বা কোথাও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়, এবং রোগীকে কোনো কারণেই বগলে ইনজেকশন দেওয়ার সুযোগ নেই বা দেওয়া হয় না। তিনি এ সংবাদকে সম্পূর্ণ ভুয়া, অসত্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দেন।

ফেসবুকে ভাইরাল এই পোস্টটির ব্যাপারে ফ্যাক্টওয়াচ আইসিইউতে কর্তব্যরত কয়েকজন চিকিৎসকের মতামত নেয়। দাবিকৃত পয়েন্টগুলো নিয়ে চিকিৎসকদের সাথে আলোচনা করে পাওয়া তথ্যগুলো এখানে গুছিয়ে উপস্থাপন করা হলো।

১) ICU-তে যে ধরনের রোগীকে ভর্তি করা হয়ে থাকে

আইসিইউতে মূলত সংকটাপন্ন রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য ভর্তি করা হয়। যেসব রোগীর শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতির কারণে বিশেষ চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হয় তাদের আইসিউতে রেখে প্রয়োজনমত চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে।

২) আইসিউতে মৃত রোগীকে জীবিত দেখানো এবং শ্বাস প্রশ্বাস করানোর কোনো উপায় আছে কি না

একজন রোগীকে কখন জীবিত ও মৃত বলা যায় সেটি প্রথমত বোঝার বিষয়। মানুষের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ জায়গা আছে যেটাকে বলা হয় ব্রেইন স্টেম, এটি শ্বাস প্রশ্বাস, হার্ট রেট এসবকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু ক্রিটিকাল রোগীর ক্ষেত্রে এমন হয় যে ব্রেইনের পুরা কর্টেক্স কাজ করা বন্ধ করে দেয়, কিন্তু ব্রেইন স্টেম কাজ করে। এই অবস্থাকে ভেজিটেটিভ স্টেট বলে। এ স্টেটে থাকা রোগীর ব্রেইন স্টেম কার্যকর থাকে, কিছুটা চৈতন্য থাকে, মাঝেমধ্যে চোখ খুলে তাকায়, মাঝেমধ্যে নিজে নিজে শ্বাস নিতে পারে। এদের ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা থাকে। আরেক ধরনের ক্রিটিকাল রোগী হচ্ছে ব্রেইন এ আঘাত বা অন্য কারণে ইঞ্জুরি হয়েছে অথবা ফুসফুস বা অন্য কোন রোগের কারণে নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারে না, সেক্ষেত্রে তাদেরকে মেকানিকাল ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এসব রোগীর ব্রেইন স্টেম কার্যকর থাকে, কিন্তু কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের শরীরের সেরে ওঠার প্রক্রিয়াকে সাহায্য করা হয়।

আরেক ক্যাটাগরির রোগী আছে যাদেরকে বলা হয় ব্রেইন ডেড পেশেন্ট, এদের ব্রেইন স্টেম অকার্যকর এবং বেঁচে আসার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এ ধরনের রোগীকে লিগ্যালি মৃত বলা যায়। এখন এদেরকে কৃত্রিমভাবে মেশিনে ভেন্টিলেট করা বা ওষুধের সাহায্যে তাদের শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ানো বা হার্ট বিট করানো সম্ভব, বাইরের দেশগুলোতে যেখানে মৃত রোগীদের অর্গান ডোনেশনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া রয়েছে সেখানে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের অঙ্গগুলোকে কিছু সময়ের জন্য সক্রিয় রাখা হয়।

রোগী ব্রেইন স্টেম সক্রিয় আছে নাকি ব্রেইন ডেড হয়ে গেছে এটা একটা ক্লিনিকাল ডিসিশন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রোগী জীবিত না মৃত সে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটি খুবই কঠিন একটি প্রক্রিয়া। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ড বসে, এবং নানারকম প্যারামিটার এবং যুক্তিতর্কের মাধ্যমে রোগীর মৃত্যুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং মানসম্মত আইসিইউ ফ্যাসিলিটিগুলাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া সাধারণত দায়িত্বশীল সিনিয়র কনসাল্টেন্টরাই করে থাকেন। এখন এই সিদ্ধান্তগ্রহণের পুরো প্রক্রিয়ার সাথে রোগীর আত্মীয়-স্বজনদেরকে অবহিত করে না রাখলে বা এই ক্ষেত্রে যথাযথ স্বচ্ছ আর দায়িত্বশীলভাবে কাউন্সেলিং না করা হলে সেক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে, এবং এ প্রক্রিয়াগুলো যাতে জবাবদিহিতাপূর্ণ পরিবেশে হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাননিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আইসিইউ রোগীর ডেথ ডিক্লারেশনের মত মেডিক্যালি জটিল আর ক্রিটিকাল সিদ্ধান্ত এর ব্যাপারে ঢালাওভাবে অহেতুক সন্দেহ ও প্যারানয়া সৃষ্টিকারী ভাইরাল পোস্টগুলো মুমূর্ষু রোগী চিকিৎসাসেবাকার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।

৩) গরুকে ইনজেকশন দেওয়ার মতো কোন সিরিঞ্জ দিয়ে মানুষকে ইনজেকশন দেওয়া হয় কি না

৫০ সিসি পরিমাণের কিছু সিরিঞ্জ মানুষ ও গরু উভয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় অনেক সময়। গরুর ওষুধের ভেটেরিনারি প্রিপারেশন আলাদা থাকে, তবে অনেক সময় কিছু অশিক্ষিত লোক মানুষের জন্য তৈরি কিছু ওষুধ, গবাদি পশুর ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। কিন্তু গরুকে দেওয়ার জন্য তৈরি কোন ওষুধ মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করার দাবিটি সম্পূর্ণ হাস্যকর ও অযৌক্তিক।

৪) মৃত রোগীর বাম বগলে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে হৃদস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার ব্যবস্থা আছে কি না

আইসিইউতে কিছু রোড ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্টের রোগী ভর্তি থাকে তাদের বুকের ভেতরে জমা পানি বা বাতাস বের করতে অনেক সময় বুকের পাশ দিয়ে নল ঢুকানো হয়ে থাকে, উল্লেখ্য এই নলের সাহায্যে বাতাস শুধুমাত্র বের করা হয়, ঢোকানোর কোন উপায় এতে নেই। এছাড়া আইসিইউতে থাকা রোগীর জন্য যে ওষুধপত্র প্রয়োজন সেগুলো হাতের ক্যানুলা, অথবা গলায় সাব ক্ল্যাভিয়ান শিরা দিয়ে শরীরে প্রবেশ করানো হয়,  বগলে অবস্থিত অ্যাক্সিলারি ভেইনের এক্ষেত্রে ব্যবহার নেই বললেই চলে।

৫) এভাবে কমপক্ষে ২৪-৩২ দিন একজন রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কি না, অথবা জীবিত দেখানো যায় কি না

একজন রোগীর ব্রেইন যখন ইন্যাক্টিভ হয়ে পড়ে তখন সে কার্যত মৃত ব্যক্তি। ব্রেইন অকেজো হওয়ার পর তার সম্পূর্ণ শরীরের হরমোন, কিডনি, পাকস্থলি, রোগপ্রতিরোধকারী সিস্টেম সবকিছু কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে শুধুমাত্র ভেন্টিলেটর আর হার্টের ওষুধের মাধ্যমে এক সপ্তাহের মত একজন রোগীকে শ্বাস-প্রশ্বাস সচল দেখানো যেতে পারে, সেক্ষেত্রেও সারা শরীরে নানারকম ইনফেকশন ও অন্যন্য অনেক প্রকারের সমস্যার কারণে দেহে পচন শুরু হয়ে যেতে পারে।

সবশেষে চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, একজন প্রিয় মানুষের মৃত্যু রোগীর স্বজনদের কাছে সবসময়েই কঠিন একটা ব্যাপার, এবং এ ধরনের গরুর ইঞ্জেকশন ধরণের হাস্যকর গুজব টাইপ পোস্টগুলোর পেছনকার সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো বোঝার আছে। একটা ভেন্টিলেটরে রাখা রোগী, যার হৃদপিন্ড আর শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া চলমান তেমন একজন রোগীকে মৃত ঘোষণা করা হলে স্বাভাবিকভাবেই রোগীর স্বজনদের কাছে সেটা একটা বড় একটা মানসিক আঘাতের ব্যাপার। ব্যক্তি পর্যায়ে ও সামাজিকভাবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে যদি যথাযথ আস্থা আর বিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি না থাকে তাহলে সেখানে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হয়। দেশের জনগণের এই আস্থার সংকটের জায়গাটাকেই পুঁজি করে এই ধরণের গুজবধর্মী পোস্টগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এখানে প্রথম দায়িত্ব আসে দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসকদের যাদের কাজ হচ্ছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা আর জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি করা, এরপর দায়িত্ব আসে চিকিৎসক এবং রোগীর স্বজন উভয়েরই। চিকিৎসকদের যেমন পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব আইসিইউতে থাকা রোগীদের স্বজনদেরকে নিয়মিত, পরিষ্কার ও যথাযথ ব্রিফিং দেওয়া, ধৈর্য্যশীলতার সাথে রোগীর স্বজনদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া। তেমনি রোগীর স্বজনদেরও দায়িত্ব সংকটময় পরিবেশে চিকিৎসকদেরকে চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সহায়তা করা।

এ বছর ১৭ এপ্রিল একটি বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ফোরাম Science Bee-তে এই গুজবটির সত্যতা জানতে চেয়ে করা প্রশ্নের উত্তরে উত্তরদাতা মেডিকেল শিক্ষার্থী ঋভু দত্তের লেখা উল্লেখ করেন যেখানে ঋভু দত্ত যুক্তিসহকারে একে বানোয়াট এবং গুজব বলে সাব্যস্ত করেছেন।

পাদটীকা : বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে অর্থের লোভে আইসিইউতে অতিরিক্ত সময় রোগীকে ভর্তি রাখার অভিযোগ চলে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। কিছু পত্রিকার এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পড়ুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

অনুসন্ধানের পর ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত হলো, এই সংবাদ পুরোপুরি ভিত্তিহীন, উদ্ভট এবং সাধারণ মানুষের মেডিকেল জ্ঞানের অভাবের সুযোগে তৈরি হওয়া একটি গুজব। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ব্যবসা নিয়ে জনমনে গত কয়েক বছরে যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে গুজবটি ছড়ানো হচ্ছে। ফ্যাক্টওয়াচ একে মিথ্যা ও গুজব বলে আখ্যায়িত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply