চট্টগ্রাম একুশে বই মেলায় ইসলামি বই নিষিদ্ধের গুজব

Published on: February 22, 2022

চট্টগ্রাম একুশে বই মেলায় ইসলামি বই বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ- এমন একটি খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এই খবরের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ফেসবুকের বাইরে মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে ইসলামি বই নিষিদ্ধের কোনো খবর ও পাওয়া যায়নি। মেলা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই মেলায় ইসলামি কিংবা ধর্মীয় বই রাখা যাবে, তবে মৌলবাদী ভাবধারার বই রাখা যাবে না।

গুজবের উৎস

১৬ই ফেব্রুয়ারি দুপুর ১ টায় বাঁশের-কেল্লা সাতকানিয়া পেজ থেকে এই স্ট্যাটাসে জানানো হয়, ইসলাম সম্পর্কিত বই প্রকাশের জন্য পরিচিত ‘প্রচ্ছদ প্রকাশন’ আসন্ন চট্টগ্রাম বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পায়নি।

একই সাথে এই পোস্টে মন্তব্য করা হয়- ‘খুব সম্ভবত, এবার চট্টগ্রাম বইমেলায় কোনো ইসলামি বই-ই বিক্রি করতে দেওয়া হবে না।‘

পরবর্তী সময়ে বাঁশের-কেল্লা সাতকানিয়া’র এই মন্তব্যকে একটু পরিবর্তন করে ‘খবর’ হিসেবে ফেসবুকে প্রচার করতে দেখা যায়। যেমন- ১৬ই ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫ টা ২ মিনিটে পর্দা- The sign of modesty পেজের এই পোস্টে দাবি করা হয়-  এবার চট্টগ্রাম বইমেলায় কোনো ইসলামি বই-ই বিক্রি করতে দেওয়া হবে না

পরবর্তী কয়েক দিন ধরে ‘চট্টগ্রাম বইমেলায় কোনো ইসলামি বই বিক্রি করতে দেওয়া হবে না’-মর্মে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজবকে ভিত্তি করে অনেক পোস্টার কিংবা ভিডিও ও ফেসবুকে দেখা যায়।  এমন কয়েকটি গুজবের পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ।


ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

চট্টগ্রামে ১০ ফেব্রুয়ারি বই মেলা শুরুর কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে তারিখ পরিবর্তন করে ১৭ ফেব্রুয়ারি করা হয়। প্রস্তুতির অভাবে পিছিয়ে দেওয়া হয় সেই তারিখও। অবশেষে ২০শে ফেব্রুয়ারি এম.এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন মাঠে এই মেলার উদ্বোধন করা হয়। এই মেলার আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ।

২০শে ফেব্রুয়ারি রবিবার বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘মেলায় ইসলামিক ও ধর্মীয় বই রাখা যাবে না, এমন অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এসব বই রাখা যাবে না, এমন কথা কোথাও বলা হয়নি। অবশ্যই ইসলামি বই রাখা যাবে। কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলতে চাই কোনো মৌলবাদী বই রাখা যাবে না। অনেক ইসলামি প্রকাশনা এখানে রয়েছে। কোনো মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় কান দেবেন না, গুজবে কান দেবেন না।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বই মেলা আয়োজন কমিটি এবং চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি শাহ আলম বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, বইমেলায় ইসলামি বই প্রকাশের কোন বাধা নেই। যেসব বই এ জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ বা উস্কানিমূলক কন্টেন্ট রয়েছে সেসব বই মেলায় পাবলিশ না করার জন্য বলা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এবারের বই মেলার ১২১টি স্টল রয়েছে। ২২টি প্রকাশনা সংস্থার আবেদন বাতিল করা হয়েছে। এই ২২টির সবগুলোই যে ইসলামি বই প্রকাশ করছে তা নায়। বইমেলার বিধিমালা না মানায় আমারা অনেকের আবেদন নেইনি।

অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া অমর একুশে বইমেলা চট্টগ্রাম ২০২২ এর স্টল বরাদ্দের একটি আবেদন ফর্মে দেখা যাচ্ছে , মেলার স্টলে স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও পাইরেসি কোন বই না রাখার কথা বলা হয়েছে ।


উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ মহামারীর কারনে গত ২০২১ সালে চট্টগ্রামে কোনো বইমেলা হয়নি। এর আগে ২০২০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বইমেলাতেও স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, দেশবিরোধী এবং জঙ্গিবাদকে উদ্বুদ্ধ করে এরকম বই বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল

একই সাথে , ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখা বই এবং পাইরেটেড বই ( মূল লেখক/প্রকাশকের অনুমোদনবিহীন নকল বই) ও এই বইমেলায় নিষিদ্ধ ছিল।

বইমেলার বর্তমান পরিস্থিতি

চট্টগ্রাম বইমেলার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এ মেলায় বরাদ্দপ্রাপ্ত ৯২ টি স্টলের নামের তালিকা পাওয়া যাচ্ছে । এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকাশনীকে সনাক্ত করা যাচ্ছে, যারা কেবলমাত্র ইসলাম সম্পর্কিত বইই প্রকাশ করে।

জাগো নিউজ এর এই প্রতিবেদন এ বলা হয়েছে, সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মেলার আয়োজক কমিটি একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) জনসংযোগ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কালাম চৌধুরী সই করা বিজ্ঞপ্তিটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে মেলার আহ্বায়ক ও চসিকের ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমদ মঞ্জু বলেন, মেলায় প্রথম থেকেই কমিটির সিদ্ধান্ত ছিলো, কোনো স্বাধীনতাবিরোধী বই প্রদর্শন বা বিক্রি করা যাবে না। এছাড়া জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করে এমন বই মেলায় থাকবে না। কিন্তু একটি গোষ্ঠী অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, মেলায় ইসলামি বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ এই মেলাতে অনেক ইসলামি প্রকাশক স্টল বরাদ্দ নিয়েছেন এবং তাদের বই অবাধে প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মেলায় অনেক ধর্মীয়গ্রন্থ প্রদর্শিত ও বিক্রি হচ্ছে। আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া প্রকাশনা, দ্বীন দুনিয়া প্রকাশনা, মাইজভান্ডারি প্রকাশনা, পাঞ্জেরি প্রকাশনা ও সেলফীসহ অনেক ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশনা এ মেলায় অংশ নিয়েছে। তারা তাদের স্টলে বিক্রি করছে বই।

বিবৃতিতে মেলা কমিটি এ ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ এবং সহযোগিতা কামনা করে।

অনেকে এ সকল স্টল এর সামনের ছবি আপলোড করে ফেসবুকে জানান দিচ্ছেন, চট্টগ্রাম বইমেলায় ইসলামী বই প্রদর্শিত হচ্ছে । এ ধরনের বই নিষিদ্ধ নয়।
 

এছাড়া, ‘অমর একুশে বইমেলা চট্টগ্রাম’ নামক আনভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে গত ২১শে ফেব্রুয়ারি আপলোড করা একটি ভিডিওতে মেলার বিভিন্ন ইসলামি বইয়ের স্টল এবং বিভিন্ন ইসলামি বই দেখানো হয়।

অর্থাৎ, সকল তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি অমর একুশে বইমেলা-চট্টগ্রামে ইসলামি বইকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কাজেই এ সংক্রান্ত গুজবের কোনো সত্যতা নেই।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply