সামাজিক মাধ্যমে গত ২৬ জুন ২০২১ থেকে পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের নামে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। সাদাকালো এই ভিডিওতে জনৈক বৃদ্ধ নিজেকে ‘পল্লীকবি’ দাবি করে কবিতার মত করে কিছু কথা বলেন। এক মিনিট এর এই ভিডিওটি ‘’ পল্লীকবি জসীম উদ্দীন কথা গুলো সত্যি অসাধারণ’’ শিরোনাম সহ বিভিন্ন ফেসবুক ব্যবহারকারী শেয়ার করছেন। ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধানে দেখে গেছে, ছবির এই বৃদ্ধ নিজেকে ‘পল্লীকবি’ দাবি করলেও তিনি পল্লীকবি জসীম উদ্দীন নন। আসল পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এর সাথে ভিডিওর এই লোকের চেহারা এবং গঠন মিলে না। বরং এটি কুড়িগ্রাম এর অধিবাসী রাধাপদ সরকার এর ভিডিও বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। |
উৎস
গত ২৪ ঘন্টায় এই ভিডিওটা কয়েকশো বার ফেসবুকে শেয়ার করা হয়েছে।
যেমন , লাইভ চ্যানেল বাংলাদেশ গ্রুপে জনৈক মোঃ আরিফুল ইসলাম গত ২৬শে জুন সন্ধ্যা ৭-৩৭ এ এই ভিডিওটি আপলোড করে লিখেছিলেন,
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন
কথা গুলো সত্যি অসাধারণ
যারা কলম ধরা শিখছে, তারাই এই দেশ খাইছে।
আমার কথার কোনো মূল্য নেই কারন আমি গরীব।
কথা গুলো সত্যি অসাধারণ ছিলো!
এই গ্রুপ থেকে সাদাকালো এই ভিডিওটি কমপক্ষে ১৩০০ বার শেয়ার করা হয়েছে ।
আরো বিভিন্ন গ্রুপেও অনুরূপভাবে এই ভিডিওটা শেয়ার করতে দেখা গেছে। যেমন –এখানে, এখানে, এখানে , এখানে, এখানে
অনেক জায়গায় ভিডিওর পিছনে ‘Shamim’ কিংবা ‘Ovi” ওয়াটারমার্ক দেখা যাচ্ছে। তবে মূল শামীম বা অভিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
কি আছে এই ভিডিওতে ?
১ মিনিট ৩ সেকেন্ডের সাদাকালো এই ভিডিওতে গ্রামীণ ফসলের মাঠের পটভূমিতে এক বৃদ্ধকে নিচের কথাগুলো বলতে শোনা যায় ,
এই দেশ নষ্ট করেছে কারা ?
যারা কলম ধরা শিখেছে,তারাই দেশকে খাইছে।
কথাটা বোঝলেন নাকি আমার?
আমি পল্লীকবি, কবিতা বানাই। কিন্তু আমার কবিতা তো কেউ শুনবে না।
কারন আমরা গরীব মানুষ । গরীব মানুষের কোনো দাম নেই।
এই যুগটা হইল কি জানেন ?
কেয়ামতের নমুনা, জানি কিন্তু মানিনা।
গুনাহগার দোযখী হবে সে কথাও তো শুনিনা।
গুন্ডাপান্ডা হারামখোর তারা হইল দোজখ
দিনদুপুরে মানুষ মারে তারা হইল দুনিয়া
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা
সরকারী চাকরি করে ,বেতন ৫ হাজার
৫০ হাজার টাকা মাসে খরচ দেখি তার
বাকি টাকা কেমনে আসে সে কথা আর বলিনা
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা
ডিজেল ভেজাল পেট্রোল ভেজাল অক্টেন ভেজাল
ভেজাল পদ্মা মেঘনা যমুনা
অর্থাৎ, কোম্পানি ভেজাল
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা
ভেবে কয় রাধাপদ সরকার
মানুষ হওয়া কি ছিল দরকার
পশু হওয়া ছিল ভালা
আখেরাতের কাজ করিনা
অর্থাৎ পরকালের কাজ করিনা
কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানিনা
বৃদ্ধের মাথায় চুল কম , মুখে দীর্ঘ পাকা দাড়ি । গলায় কালো রঙের একটা মালা । শরীরের উর্ধাঙ্গে কোনো কাপড় নেই, তবে আড়াআড়িভাবে একটা সুতা দেখা যাচ্ছে ( হিন্দু ব্রাহ্মণ দের ব্যবহার করা পৈতার মত)।
ভিডিওর শেষ অংশে তিনি নিজেকে ‘রাধাপদ সরকার’ বলে দাবি করেছেন ।
বৃদ্ধের পাশে আরো কয়েকজন বয়স্ক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। একটি মোটরসাইকেলও দেখা যায়।
কে এই রাধাপদ সরকার ?
দুইমাস আগে গত ২৯শে এপ্রিল ২০২১ তারিখে Md Al Amin তার ফেসবুক একাউন্ট থেকে একই ভিডিও শেয়ার করেন। তবে সেটি ছিল রঙিন এবং ১ মিনিট ৪ সেকেন্ডের। ভিডিওর ক্যাপশনে তিনি লিখেছিলেন,
এর থেকে সত্য হয়তো হয়না।
নামঃ রাধাপদ রায়।
তাঁর বাড়ী কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার
ভিতরবন্দ ইউনিয়নে
গ্রামঃ মাধাইখাল, গোড্ডারারপাড়।
(তথ্যসূত্রঃ দীপক কুমার রায়)
একই ক্যাপশনে এই ভিডিওটা আরো কয়েক জায়গায় শেয়ারড হতে দেখা যায়। যেমন এখানে, এখানে
২৯শে এপ্রিলের আগেও এই ভিডিওটা বিস্তারিত ক্যাপশন ছাড়া কয়েকজায়গায় দেখা গিয়েছে। যেমন ফেসবুকে এমনকি ইউটিউবে
তথ্যসূত্র হিসেবে কয়েক জায়গায় দীপক কুমার রায় এর উল্লেখ করা হলেও তার কোনো ফেসবুক একাউন্ট বা অন্য কোনো যোগাযোগমাধ্যম খুঁজে পাওয়া গেল না।
রাধাপদ সরকার এর অন্য কোনো গানও এখনো পর্যন্ত অনলাইনে পাওয়া যায় নি।
‘কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু কমুনা’ শিরোনামে শাহ আলম সরকার এর একটি গান পাওয়া যায়। এই গানের সাথে রাধাপদ সরকারের গাওয়া গানটির অনেক মিল পাওয়া যাচ্ছে। শাহ আলম সরকার এই গানটি প্রকাশ করেছিলেন ১৯৯৯ সালে। ইউটিউবে বিভিন্ন শিল্পীর কভার করা ‘কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু কমুনা’ গানটা দেখা যায়। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মমতাজও এই গানটি তাঁর একটি অ্যালবামে গেয়েছেন। শাহ আলম সরকারের নিজের কন্ঠেও এই গানটা দেখা যায় ইউটিউবে।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন
লেখক ,কবি , গীতিকার, নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিক জসীম উদ্দীন এর জন্ম ১৯০৩ সালে, মৃত্যু ১৯৭৬ সালে। তার লেখায় গ্রামীণ জনপদের কথা বেশি উঠে আসে বিধায় তাকে ‘পল্লীকবি’ বলা হয়।
জসীম উদ্দিনের উইকিপিডিয়া পেজে নিচের ছবিটা রয়েছে।
অনলাইনের বিভিন্ন জায়গায় তার যে সকল ছবি রয়েছে, সেখানে কোথাও তার মুখে দীর্ঘ দাড়ি দেখা যায় না। এ ছাড়াও জসীম উদ্দীন গবেষক ও জীবনীকারদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, পল্লীকবি শশ্রুমণ্ডিত ছিলেন না। তাঁর দেহের গঠন এবং কাঠামোর সাথেও ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির ব্যক্তির সাথে মিলে না। বিভিন্ন সময়ে তাঁর মুখাবয়বের ছবি ও পোর্ট্রেট স্টাডি করে কোথাও কোনো দাড়ির লক্ষণ দেখা যায় নি।
সিদ্ধান্ত
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের নয়। কুড়িগ্রাম অঞ্চলের কোনো রাধাপদ সরকারের পুরনো একটি ভিডিও এডিট করে সাদাকালো হিসেবে রূপান্তর করে ভুল শিরোনাম যোগ করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান। |