সিলিকন দিয়ে বানানো ভাস্কর্যকে আটকে-পড়া জ্বীন দাবি

Published on: August 30, 2023

তুরস্কের ইস্তানবুলের জ্বিন পার্ক -শিরোনামে একটি ভিডিও দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এই ভিডিওতে ভাষ্যকার দাবি করেছেন, কিছু জ্বিন এই পার্কে এসে পানির কাছে ওজু করার মুহুর্তে একজন হুজুর তাদেরকে নিশ্চল করে দিয়েছেন। সেই জ্বীনেরা এখনো সেই অবস্থাতেই রয়েছে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে,এটি তুরস্কের  Saraçhane July 15 monument , যেখানে ৮ জন ব্যক্তির ভাস্কর্য বানানো হয়েছে। এটি বানানো হয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই এর সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ, এবং বেসামরিক জনতার অভ্যুত্থানের স্মরণে। ২০১৮ সালে এই ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হয় এবং এর সাথে জ্বীন বা কোনো পৌরাণিক গল্পের সম্পৃক্ততা নাই।

গুজবের উৎস:

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

এই ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হয়েছে, তুরস্ক ইস্তানবুল আকসারায় জীন পার্ক !! “আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর” এটা সত্যি যা তুরস্কে আছে আর এটা একটা অলির কারনে হয়েছে! তারা আর রুপপাল্টাতে ও যেতে পারেনি!! আল্লাহ ইচ্ছাই [বানানরীতি অবিকল রাখা হয়েছে]

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

পুরো ভিডিওতে ভাষ্যকার এই পার্কের পুরো নাম বা ঠিকানা জানায়নি, বরং ‘জ্বীন পার্ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

কথিত এই ‘জ্বীন পার্ক’ নামে কোনো স্থাপনা খুজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

ইস্তাম্বুলে পরী আটক গুজবের সত্য উদঘাটন
শীর্ষক এই ইউটিউব ভিডিওতে গিয়ে উক্ত স্থাপনাটির একটি ভিন্ন ইতিহাস জানা গেল। ভিডিও থেকে দেখা যাচ্ছে, এই স্থাপনাটির নাম July 15 Sarachane Movement।

এই ভিডিওর বিবরণ থেকে , এবং পরবর্তীতে গুগল সার্চের মাধ্যমে অন্যান্য উৎস থেকে জানা গেল, ২০১৬ সালের ১৫ই জুলাই দিবাগত রাতে তুরস্কের সামরিক বাহিনীর একদল সেনা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোয়ানের সরকারের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান পরিচালনা করে । প্রেসিডেন্ট এসময় রাজধানী থেকে দূরে অন্য একটি শহরে ছিলেন।

১৫ জুলাই রাত ৯ টার পর অভ্যুত্থানকারী দল ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার মূল পয়েন্টসমূহ, বিমান বন্দর, টার্কিশ জেনারেল স্টাফের সদর দপ্তর, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তর, প্রেসিডেন্টের বাসভবন, সংসদ ভবন ও বসফরাস প্রণালির মূল ব্রিজে অবস্থান নেয়। অভ্যুত্থানকারীরা জাতীয় টেলিভিশন থেকে অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করে । তারা ইন্টারনেট পরিসেবাও বন্ধ করে দেয়।

অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টা পর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান নাটকীয়ভাবে বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে একটি ভিডিও বার্তা পৌছাতে সক্ষম হন। তিনি তার বার্তায় সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান ঠেকাতে জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। এই আহবানে তুমুল সাড়া পাওয়া যায়। এরদোয়ানের রাজনৈতিক দল একে পার্টির সদস্যসহ সাধারণ ব্যক্তিরাও সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ ঠেকাতে রাজপথে নেমে আসে। রাজপথে বেসামরিক লোকদের বিপুল উপস্থিতি দেখে সেনাবাহিনীও পরবর্তীতে বল প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকে। ভোর ৪ টা নাগাদ প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান রাজধানীর বিমানবন্দরে অবতরণ করে এবং বিপুল সংখ্যক জনতা তাকে অভিনন্দন জানায়। সকাল নাগাদ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

সরকারি হিসাবমতে, অভ্যুত্থানের ফলে সংঘটিত সংঘর্ষে ১৬১ জন বেসামরিক মানুষ ও ১০৪ জন অভ্যুত্থানকারী সেনাসদস্যসহ মোট ২৬৫ জন প্রাণ হারায়।

The Istanbul Metropolitan Municipality এর সামনে একটা জলাধার ছিল। এবং তার সামনে ব্যস্ত রাস্তা ছিল। সেনাবাহিনীর অগ্রগমন ঠেকাতে সে রাতে অস্ত্রবিহীন বেসামরিক নাগরিকদের এই পথ দিয়ে অনেক ব্যস্ত চলাচল অনুমান করা যায়। এখানকার একটি সিসি টিভি ফুটেজে রাত ৩ টা ৭ মিনিটে ৮ জন ব্যক্তিকে একত্রে এখানে ওজু করতে দেখা যায়। ইসলামী রীতিতে ওজু হল হাত,পা সহ শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গ নির্দিষ্ট নিয়মে ধৌত করা। সাধারণত নামাজ,প্রার্থনা বা কোনো ইসলাম ধর্মীয় কাজ শুরুর আগে ওজু করার চল রয়েছে।

এই ৮ ব্যক্তির সবাই পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীকে বাধা দিতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন কিনা, এটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে উক্ত স্থানেই উক্ত ৮ জন ব্যক্তির অনুকরণে সিলিকন, ফাইবার এবং আসল চুল দিয়ে ওজুরত অবস্থায় ৮ টি ভাস্কর্য বানানো হয়েছে । ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ২ বছর পরে,  ২০১৮ সালের ১৫ই জুলাই এই স্থাপনাটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। এর নাম   Saraçhane July 15 monument

এই স্থাপনার সামনে একটি মিনারে উক্ত দিনের ঘটনার স্মরণে যা লেখা রয়েছে, তার শেষ অনুচ্ছেদ অনুবাদ করলে দাড়ায়, আমাদের দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিলনা, তবে ওজুকেই তারা অস্ত্র হিসেবে নিয়েছিল। মৃত্যুকে তারা ভয় পেতনা, তবে ওজুবিহীন অবস্থায় তারা মৃত্যুবরণ করতে চায়নি।

অর্থাৎ, এই ভাস্কর্যগুলো সম্পূর্ণ মনুষ্যনির্মিত। অলৌকিক কোনো উপায়ে তৈরি হয়নি, কিংবা জ্বীন বা অন্য কোনো প্রাণী এখানে আটকা পড়ার কারণে এমন অবস্থা হয়নি। অতএব , ফ্যাক্টওয়াচে ছড়িয়ে পড়া ‘জ্বীনের পার্ক’ এর দাবিযুক্ত ফেসবুক পোস্টগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

উল্লেখ্য, ইসলামি মিথলজি অনুযায়ী, জ্বীন একটি অদৃশ্য প্রাণী, যা মানুষসহ যেকোনো প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারে, আবার পুনরায় অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh