কলেজ শিক্ষিকার খুনী তার স্বামী– ময়না তদন্তে এটি বলা হয়নি

Published on: August 18, 2022

সম্প্রতি আলোচিত কলেজ শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে “এইমাত্র ময়না তদন্তের রিপোর্টে ধড়া পরলো কলেজ শিক্ষিকা কে তার স্বামি মেরেছে” শিরোনামের পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল পোস্টগুলোতে বিভিন্ন রকম নিউজ চ্যানেলের ভিডিও এডিট করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। 

ফ্যাক্ট-ওয়াচের অনুসন্ধানে কোথাও ময়না তদন্ত রিপোর্টে, খায়রুন নাহারের স্বামী মামুন তাকে হত্যা করেছে এমন প্রমাণ মেলেনি। এমনকি এসকল ভিডিওর ক্যাপশনের সাথেও ভিতরের কন্টেন্ট এর মিল পাওয়া যায়নি।  যেহেতু সত্য-মিথ্যা বিভিন্ন রকম তথ্য দিয়ে তৈরি করা ভিডিও  মিথ্যা ক্যাপশনে ভাইরাল হয়েছে তাই ফ্যাক্ট-ওয়াচ পোস্টগুলিকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

গুজবের উৎসঃ

 গত ১৫ই আগস্ট, ২০২২ তারিখ থেকে “এইমাত্র ময়না তদন্তের রিপোর্টে ধড়া পরলো কলেজ শিক্ষিকা কে তার স্বামি মে’রেছে” এই ক্যাপশনে পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল পোস্টগুলো আলোচিত নাটোরের কলেজ শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের মৃত্যুর ঘটনাকে নির্দেশ করছে। ভাইরাল পোস্টগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন দৈর্ঘ্যের ভিডিও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ভিডিওগুলোর কোনটিতে যমুনা টিভি আবার কোনটিতে  চ্যানেল ২৪ চ্যানেলের সংবাদ ভিডিও এডিটিং করে সংযুক্ত করা হয়। এমনকি অনেক ভিডিওতে খাইরুন নাহার এর সংবাদ না দিয়ে অন্য সংবাদ যোগ করা হয়েছে।

এমনই কিছু ভাইরাল নিউজের স্ক্রিনশট দেখুন এখানে, এখানে,এখানে,এখানে,এখানে



কিছু ভিডিওর প্রথমাংশে বলা হয় “দর্শক আলোচিত সেই কলেজ শিক্ষিকার মৃত্যুর গোপন রহস্য কিন্তু বের হয়ে আসলো। ময়না তদন্তে ডাক্তার যে তথ্য পেয়েছে ডাক্তার বলতিছে এটা পরিকল্পিতভাবেই হয়েছে। দর্শক বিশেষ করে ডাক্তার কি বলতিছে সে ভিডিও আপনাদেরকে আমরা দেখাবো, আপনারা দেখে যাবেন। ্দর্শক এইদিকে এই কলেজ শিক্ষিকার মৃত্যুর পিছনে কি রহস্য আছে তার গ্রামবাসীসহ দুইজন ব্যক্তি কিন্তু মুখ খুলছে। দর্শক আগে চলুন তার গ্রামবাসী কি বলছে, তারপর সেই ময়না তদন্তের ভিডিওটা কিন্তু আপনারা দেখে যাবেন।”

.

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানঃ

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে,  ইলিয়াস হোসাইন নামক একটি ফেসবুক পেজ সহ বিভিন্ন আইডি থেকে প্রকাশিত ভিডিওতে ভিডিও এডিটিং করে যমুনা টিভি থেকে প্রচারিত একটি সংবাদ জুড়ে দেওয়া হয়। যমুনা টিভির উক্ত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে নাটোরের আলোচিত শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের মৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামী মামুন হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫৪ ধারায় আটক করা হয়। খাইরুন নাহারের মৃত্যুতে  তার চাচাতো ভাই সাবের উদ্দিন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। খায়রুন নাহারের ময়না তদন্তে গলায় আঘাতের চিহ্ন ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। পুলিশ প্রাথমিকভাবে এটাকে আত্মহত্যা হিসেবে ধারণা করছে। কিন্তু যেহেতু খায়রুন নাহারের মৃত্যুটি একটি আলোচিত ঘটনা তাই সিআইডি একটি ছায়া তদন্ত করবে।

যমুনা টেলিভিশনের মূল সংবাদটি দেখুন এখানে,

 

তবে উক্ত সংবাদের কোথাও বলা হয়নি ময়না তদন্তে পাওয়া গেছে খায়রুন নাহারকে তার মামুন হোসেন খুন করেছে।

Sadia Mim নামক একটি ফেসবুক পেজসহ অন্য কয়েকটি পেজ থেকে প্রকাশিত ভিডিওতে বলতে শোনা যায় ডাক্তার বলেছে এই মৃত্যু পরিকল্পিতভাবেই হয়েছে। চ্যানেল ২৪ এর একটি সংবাদও এডিটিং করে সেখানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

আমরা চ্যানেল ২৪ এর ইউটিউব চ্যানেল থেকে উক্ত সংবাদটি খুজে বের করি। ৫৫ সেকেন্ডের উক্ত সংবাদে ভয়েস কলে চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক জানান  “প্রাথমিকভাবে পুলিশের যে সুরতহাল রিপোর্ট প্লাস হচ্ছে আমরা দেখে ধারণা করছি যে এটা হ্যাঙ্গিংই হতে পারে। ফাইনাল অপিনিয়নটা দিতে পারবো রিপোর্টগুলো আসার পরে। রিপোর্টগুলো আসতে ম্যাক্সিমাম দুইমাস লাগে। তবে এই কেসের জন্য এতদিন লাগবে না।”

চ্যানেল ২৪ এর মূল সংবাদ দেখুন এখানে,

তবে এই সংবাদেও খায়রুন নাহারকে তার মামুন হোসেন খুন করেছে ময়না তদন্তে এমন কিছু কোথাও বলা হয়নি।

মানব জমিনের ১৫ই আগস্ট,২০২২ তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, নাটোরে কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করে ভাইরাল হওয়া সেই শিক্ষিকা খাইরুন নাহারের ময়নাতদন্ত শেষে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। নাটরের ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান “তার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নির্যাতন কিংবা আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। শ্বাসরোধেই তার মৃত্যু হয়েছে। মরদেহের গলায় একটি দাগ ছাড়া অন্য কোনো জখম বা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।”

নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সামিউল ইসলাম জানান, শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শ্বাসরোধ হওয়ার কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তারপরও ভিসেরা রিপোর্ট এলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

মানবজমিনের রিপোর্টটি পড়ুন এখানে,

মানবজমিন ছাড়াও কালেরকণ্ঠ, বাংলা নিউজ ২৪.কম, আজকের পত্রিকা সহ অনেক গণমাধ্যম থেকেই একই সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।

সেগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে

তবে কলেজ শিক্ষিকা খায়রুন নাহারকে তার স্বামী হত্যা করেছে এমন তথ্য ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়নি।

উল্লেখ্য, খুবজীপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহার। প্রথমে বিয়ে করেছিলেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। প্রথম স্বামীর ঘরে একজন সন্তানও ছিল। পারিবারিক কলহে সংসার বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি। তারপর কেটে যায় অনেক দিন। একপর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) পরিচয় হয় ২২ বছরের যুবক মামুনের সঙ্গে এবং দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। অবশেষে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর তারা দু’জন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রায় আট মাস আগে বিয়ে করলেও খবরটি ছড়িয়ে পড়ে জুলাই মাসের শেষ দিকে। এরপরই কলেজ শিক্ষিকার কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করার ঘটনাটি দেশজুড়ে  আলোচিত হয়।

যেহেতু ভাইরাল পোস্টগুলোর ভিডিওতে সত্য মিথ্যা বিভিন্ন তথ্য মিশিয়ে প্রচার করা হয়েছে, কিন্তু ক্যাপশনে সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি তথ্য দেওয়া হচ্ছে তাই ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh