ফুটবল খেলা নিয়ে সংঘর্ষকে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ বলে পাল্টাপাল্টি প্রচার

Published on: [July 26,2021]

গত ২১ জুলাই ঈদুল আযহার দিনে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়  হিন্দুরা নামাজরত মুসল্লিদের উপর হামলা চালিয়েছে, কিংবা সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালিয়ে মুসলমানরা ঈদ উৎসব পালন করেছে —এমন ধরনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের খবর দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে , ঈদের দিন ২১ জুলাই কোটালিপাড়ায় ২ দল গ্রামবাসীর মধ্যে একটি সংঘর্ষ হয়েছিল ঠিকই, তবে সেটি ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। ফলে এই দুই ধরনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” মনে করে।

বিভ্রান্তির উৎস

বিভিন্ন ফেসবুক প্রোফাইল, পেজ এবং গ্রুপ থেকে এই সংক্রান্ত খবর শেয়ার করা হচ্ছে। এমন কিছু খবর দেখুন এখানে ,  এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে


শাহিন শেখ নামের প্রোফাইল থেকে ২১শে জুলাই সন্ধ্যায় আপলোড করা পোস্টে বলা হয়েছে,

*****হিন্দু -মুসলিম সংঘর্স ******

কোটালিপাড়া, দিঘোলিয়া ১১বাড়ি  গ্রামে ঈদুল আজহা নামাজরত অবস্থায় মোসলমানদের উপর হিন্দুত্ব বাদী সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায়, পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে, কিছু বুঝে উঠার আগেই  মসজিদ সহ অনেক মুসলমানদেরকে আহত করা হয়েছে , তাছাড়া অনেক মুসলমাদের বাড়ি ঘড় লুটপাট এবং ভাংচুর করা হয়েছে!

“নিক্সন  চৌধুরী” নামের পেজ থেকে ২৩শে জুলাই সন্ধ্যা ৭ টায় আপলোড করা পোস্টে বলা হয়েছে ,

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় হিন্দুরা ঈদের দিনে মসজিদে নামাজরত মুসল্লীদের উপর হামলা চালিয়েছে। এ সময় ৫০ এর অধিক মুসলমানকে হিন্দুরা গুরুতর আহত করে হাসপাতালে পাঠায়। ঐ এলাকার চেয়ারম্যান বিমল চন্দ্র বিশ্বাস এ হিন্দুত্ববাদী হামলার পেছনে অন্যতম ইন্ধনদাতা। ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক বিমল বিশ্বাসের ভয়ঙ্কর সব সাম্প্রদায়িক কথাবার্তার ভিডিও ফেসবুকে ঘুড়লেই পাওয়া যায়।

তবে মজার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে এত বড় একটা হিন্দুত্ববাদী হামলার ঘটনা ঘটে গেলেও মিডিয়া তাকে ‘ফুটবল খেলা নিয়ে সংঘর্ষ বলে লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু কোরবানীর ঈদের দিন মসজিদের মধ্যে কারা ফুটবল খেলতে গিয়েছিলো সেই তথ্য প্রকাশ করেনি।

দৈনিক কোটালিপাড়া নামক ফেসবুক গ্রুপ থেকে ঈদের দিন সকাল থেকে এই গুজবের সূত্রপাত হয় বলে ফ্যাটওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে । এই গ্রুপে ২১শে জুলাই বিভিন্ন সময়ে ‘হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হচ্ছে’ মর্মে পোস্ট করা হয়। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে, এখানে, এখানে

একই গ্রুপে অনেকে ভিন্ন খবর শেয়ার করে । তারা জানান, এটা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নয় বরং ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ। যেমন- এখানে।

সবগুলো পোস্টেই এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলেছিল। তবে এই রিপোর্ট লেখার সময় দেখা যাচ্ছে, দৈনিক কোটালিপাড়া ফেসবুক গ্রুপের এডমিন সংঘর্ষ সংক্রান্ত সকল পোস্টেই কমেন্ট করার অপশন বন্ধ করে রেখেছেন।

ঘটনার বিকল্প বিবরণ

অন্যদিকে , ঘটনার বিপরীত বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, সনাতন ধর্ম সহ বেশ কিছু গ্রুপে।

এই পোস্টে বলা হয়,

ব্রেকিং নিউজ – গোপালগঞ্জে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে ঈদ উৎসব পালন করা হয়েছে সকাল ৯টার দিকে। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ী ইউনিয়ন পারাকাটা বাজারে আজ সকালে নিরীহ হিন্দুদের উপর বর্বর হামলা ও ভাংচুর  । বহু আহত।

এই জাতীয় কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

২১শে জুলাই বিকাল ৩-৪০ মিনিটে বাংলাদেশ হিন্দু যুব পরিষদ – গাজীপুর জেলা এর প্রচার সম্পাদক জনি তালুকদার এই ছবি এবং স্ট্যাটাস দেন , যা এখন পর্যন্ত ৩৪০ বার শেয়ার করা হয়েছে। পাবলিক ডোমেইনে এটাই গোপালগঞ্জের ঘটনাকে  ‘হিন্দুদের উপর হামলা’ দাবী করে করা প্রথম ভাইরাল পোস্ট বলে ফ্যাক্ট ওয়াচ দেখতে পাচ্ছে।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে, ফ্যাক্টওয়াচ জানতে পেরেছে ,এই ছবিগুলো সবই ২১শে জুলাইয়ের । তবে আহতদের ধর্মীয় পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

এই ছবিগুলো টুইটারেও ছড়াতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে অনেক ভারতীয় ব্যবহারকারীও রয়েছেন।

ভারতভিত্তিক  হিন্দুভয়েস এবং Dopolitics এ এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে। হিন্দুভয়েসের খবরে বলা হয়েছে,  ওই গ্রামে ঈদ উপলক্ষে মুসলমানদের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। ( কোনো দলেই হিন্দু কোনো ছেলে ছিল না) খেলা চলাকালীন দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল গন্ডগোল বাধে। সেইসময় দুই পক্ষের মারামারিও শুরু হয়। সেই সময় খেলা দেখতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বেশ কিছু হিন্দু বাসিন্দা। তাদের দুই একজনকে মারধর করলে প্রতিবাদ করেন তাঁরা। তখনই পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয় । হঠাৎই হিংস্র হয়ে ওঠে কয়েকজন মুসলিম যুবক। ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু পাড়ার দিকে তেড়ে যায় তাঁরা। আল্লাহু আকবর’  স্লোগান দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপানো হয় বেশ কয়েকজন হিন্দুকে। রাস্তায় যাকেই দেখতে পেয়েছে, তাকেই কোপায় ওই মুসলিম যুবকরা।


ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান


এই খবরটা প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় এবং স্থানীয় দৈনিকে। তবে তারা সবাই জানাচ্ছে, ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এমন কিছু খবর দেখতে পাবেন –প্রথম আলো, ইত্তেফাক , ঢাকা ট্রিবিউন , দেশ রুপান্তর ,জাগো নিউজ , কালের কন্ঠ সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ।

দৈনিক কালের কন্ঠে ,২১শে জুলাই দুপুর ২-৩৩ মিনিটে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।  বুধবার ঈদুল আজহার দিন সকাল ৯টায় উপজেলার কলাবাড়ী ইউনিয়নের পাড়াকাটা গ্রামে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, গত সোমবার (১৯ জুলাই) বিকেলে পাড়াকাটা গ্রামের কিশোররা দুভাগে ভাগ হয়ে স্থানীয় জনকল্যাণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ফুটবল খেলে। খেলায় জয়-পরাজয় নিয়ে উভয় পক্ষের মাঝে কথাকাটাকাটি হয়।

এরই সূত্র ধরে আজ বুধবার সকালে পাড়াকাটা গ্রামের স্বপন গাইনের ছেলে সজল গাইনের (১৭) সাথে আজাহার মল্লিকের ছেলে জামাল মল্লিকের (৩৮) কথাকাটাকাটি হয়। এরপর দুদল গ্রামবাসী বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। খবর পেয়ে কোটালীপাড়া থানা ও ভাঙ্গারহাট নৌ-তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। গুরুতর আহত দের উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।

কোটালীপাড়া থানার ওসি মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, এলাকার পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত রয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কোনো পক্ষ থেকেই এখন পর্যন্ত থানায় অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


কালের কন্ঠের স্থানীয় সাংবাদিক এবং কোটালিপাড়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি মিজানুর রহমান বুলু ২১শে জুলাই ফেসবুকে একাধিক পাবলিক পোস্টের মাধ্যমে জানান, এখানে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি।

খুলনা অঞ্চলের আঞ্চলিক পত্রিকা, ‘দৈনিক তথ্য’ এ এই খবরটা ছবি সহ ছাপা হয়েছিল।  ফ্যাক্ট ওয়াচের পক্ষ থেকে দৈনিক তথ্যের স্থানীয় প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া গুজব পুনরায় নাকচ করে দিয়ে বলেন, পুরো সংঘর্ষটাই ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে হয়েছে। এখানে হিন্দু-মুসলমান বা অন্য কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই। ঈদের জামায়াত হয়ে যাওয়ার পরে, সকাল ৯ টায় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। ঈদগাহ ময়দান থেকে অনেক দূরে এই সংঘর্ষ হয়েছে। নামাজরত মুসল্লিদের উপর হামলার দাবিটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন।

কোটালিপাড়া পুলিশ স্টেশন এর সাথেও ফ্যাক্টওয়াচ এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও এটাকে ‘ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ’ বলে নিশ্চিত করেছে।

দৈনিক তথ্যের প্রতিবেদন এবং অন্যান্য বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া ভাইরাল ছবিটি দৈনিক কোটালিপাড়া ফেসবুক গ্রুপের এডমিন এর তোলা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। কোটালিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংঘর্ষে জনৈক আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া অবস্থায় তিনি ছবিটি তুলেছেন বলে ফ্যাক্টওয়াচকে নিশ্চিত করেছেন।

সিদ্ধান্ত

কোটালিপাড়ায় সংঘটিত সংঘর্ষটি ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। মূলধারার সকল সংবাদমাধ্যম সে কথাই বলছে। কেবলমাত্র  ফেসবুকের কিছু জায়গায় এই সংঘর্ষকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে দাবি করা হয়েছে। তবে এই দাবির সপক্ষে কোনো বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। কোটালিপাড়ার দায়িত্বশীল সাংবাদিক, পুলিশ বাহিনী কোনো সূত্র থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এসব দাবির পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ফলে ফ্যাক্টওয়াচ এসব ভাইরাল দাবিকে গুজব মনে করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply