কাটা লেবুতে লবঙ্গ গেঁথে রেখে দিলে কি মশা দূর হয়?

Published on: March 15, 2023

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে মশা তাড়ানোর উপায় হিসেবে লেবু কেটে দুইভাগ করে তাতে লবঙ্গ গেঁথে ঘরের কোণে রেখে দিলে মশার উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যাবে – এমন একটি দাবি সংবলিত পোস্ট শেয়ার করা হচ্ছে। তবে, ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, মশা তাড়ানোর উক্ত পদ্ধতিটি অকার্যকর। বরং লেবুর খোসা এবং লবঙ্গ থেকে নিষ্কাশিত (extracted) তেল মশার বিতাড়ক (repellent) হিসেবে কাজ করে। তবে, অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে যে, মশা কিংবা পোকামাকড়ের বিতাড়নে এসব উদ্ভিদজাত তেল থেকে DEET (diethyltoluamide) অনেক বেশি কার্যকর। বাজারে যেসব মশার বিতাড়ক বা রেপেলেন্ট পাওয়া যায়, এদের বেশিরভাগই DEET দিয়ে বানানো। সঙ্গত কারণে, সামাজিক মাধ্যমে এসব পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” আখ্যা দেয়ার পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ এবারের ফ্যাক্টফাইল তৈরি করেছে।

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত এমন কিছু পোস্টের নমুনা দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে এসব পোস্টকে বিভ্রান্তিকর আখ্যা দেয়ার পাশাপাশি ফ্যাক্টওয়াচ এ বিষয়টি নিয়ে আরেকটু বিশদ অনুসন্ধান করে দেখেছে।

 

মশা তাড়ানোর বিতাড়ক হিসেবে লেবু এবং লবঙ্গের ব্যবহার উল্লেখ করেছে এমন কিছু বাংলা সংবাদমাধ্যমের সংবাদগুলো পড়ুন এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

মশার বিতাড়ক (রেপেলেন্ট) কিভাবে কাজ করে?

ন্যাশনাল পেস্টিসাইড ইনফরমেশন সেন্টার এর মতে, আমাদের ত্বকের গন্ধ এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় যে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয় তা মশাকে আকৃষ্ট করে এবং মশা তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে মানুষ কিংবা অন্য প্রাণীর অবস্থান খুঁজে বের করে। মশার বিতাড়কগুলো আমাদের দেহ থেকে নির্গত গন্ধ এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড মশার ঘ্রাণেন্দ্রিয় থেকে আড়াল করে দেয় তখন মশার জন্য মানুষ ও প্রাণীর অবস্থান খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এর মতে, মশার বিতাড়কের কার্যকারিতা এবং এর স্থায়িত্ব মশার প্রজাতি, তাপমাত্রা,  আর্দ্রতা, শরীরের ঘাম, এবং অন্যান্য কারণ (factors) এর উপর নির্ভর করে।

 

লেবু কেটে লবঙ্গ গেঁথে রেখে দিলে কি মশা দূর হয়?

লেবু কেটে দুইভাগ করে তাতে লবঙ্গ গেঁথে ঘরের কোণে রেখে দিলে মশার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় কিনা তা যাচাই করতে আমরা বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে গুগল সার্চ করি এবং এশিয়ান জার্নাল অব রিসার্চ ইন ফার্মাসিউটিক্যাল সাইন্স এর একটি নিবন্ধ খুঁজে পাই সেখানে বলা হয়েছে, লবঙ্গের কুঁড়ি (buds) এবং লেবুর খোসা (lime peel) থেকে নিষ্কাশিত তেল যখন আলাদাভাবে পরীক্ষা করা হয়, তখন সেগুলো মশার বিতাড়ক হিসেবে লেমনগ্রাস, ইউক্যালিপটাস, পুদিনা পাতা, কমলালেবুর মতো কার্যকর

তাছাড়া, আরও একটি গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে যে লবঙ্গের তেল (clove oil) সাধারণ ঘনত্বের (concentration) চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ঘনত্বে মশার বিতাড়ক হিসেবে পরিমিত (moderate) কার্যকারিতা দেখিয়েছে।

 

অন্য আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে লবঙ্গের তেল যখন জলপাইয়ের তেল (olive oil) এবং নারকেল তেল (coconut oil) এর সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়, তখন তা ৭৬ মিনিট থেকে ৯৬ মিনিট পর্যন্ত কার্যকর থাকে। অন্যদিকে, লবঙ্গের তেল বাদে অন্যান্য উদ্ভিদের তেল নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সেগুলো আড়াই ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত কার্যকর।

জোসেফ কনলন (Joseph Conlon) নামক একজন ইউ.এস. নেভির অবসরপ্রাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ (entomologist) বলেছেন যে, লবঙ্গের তেল একটি পরীক্ষিত (bona fide) বিতাড়ক কিন্তু শুধুমাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঘনত্বেই এই বিতাড়কটি কার্যকর হবে এবং এই মাত্রার ঘনত্বের লবঙ্গের তেল শরীরের চামড়া পুড়িয়ে গর্ত করে ফেলতে পারে। তিনি আরও বলেছেন যে, লেবুর মধ্যে নিছক কিছু গেঁথে রেখে দিলে তা মশার বিতাড়ক হিসেবে কাজ করবে – এরকম ভাববার কোন কারণ নেই। পড়ুন এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

প্রাকৃতিক উদ্ভিদ থেকে নিষ্কাশিত তেল কি DEET (diethyltoluamide) এর চেয়ে বেশি কার্য়কর?

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন এর একটি নিবন্ধের ফলাফলে বলা হয়েছে যে, DEET ভিত্তিক মশা বিতাড়ক পণ্যগুলো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কার্যকর থাকে। ২৩.৮ শতাংশ DEET এর একটি ফর্মুলেশনে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার সুরক্ষা পাওয়া যায়। অন্যদিকে, সয়াবিন তেল থেকে বানানো একটি বিতাড়ক মশার কামড়ের বিরূদ্ধে প্রায় দেড় ঘণ্টার সুরক্ষা দেয়। আরও অন্যান্য উদ্ভিদজাত (botanical) বিতাড়কগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেগুলো ২০ মিনিটের বেশি সুরক্ষা দিতে পারে না

 

অতএব, এই বিষয়টি স্পষ্ট যে লেবু কেটে তাতে লবঙ্গ গেঁথে ঘরের কোণে রেখে দিলে তা মশা তাড়াতে কার্যকর নয় বরং লেবুর খোসা এবং লবঙ্গ থেকে নিষ্কাশিত তেল সাধারণ ঘনত্বের চেয়ে কিছু বেশি ঘনত্বে মশা তাড়াতে কার্যকর এবং লবঙ্গ বা অন্যান্য উদ্ভিদজাত তেল এর চেয়ে DEET ভিত্তিক বিতাড়কগুলো আরও বেশি কার্যকর এবং অনেক সময় পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh