মিশরে ম্যানেকুইন নিয়ে যাওয়ার ছবিকে ভারতে বিধর্মী প্রেমিকের হিন্দু প্রেমিকা হত্যাচেষ্টা বলে দাবি

Published on: June 6, 2023

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, রাজস্থানের মেয়ে বিনীতা অন্য ধর্মের এক ফল বিক্রেতার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো এবং ঐ ফল বিক্রেতা পরবর্তীতে বিনীতাকে ব্রিজ থেকে ফেলে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বস্তায় ভরে মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিলো। তবে, ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ছবিটির সাথে ভারতের রাজস্থান কিংবা কথিত “বিনীতা” এর কোন সম্পর্ক নেই বরং, ছবিটি মিশরের কায়রোর একজন ডেলিভারিম্যানের যিনি তার মোটরসাইকেলের পেছনে একটি ম্যানেকুইন (Mannequin) বেঁধে একটি কাপড়ের দোকানে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। মিশরীয় গণমাধ্যমের কয়েকটি সংবাদ এবং ভারতীয় কিছু ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থার রিপোর্ট থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। মূলত উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সৃষ্ট ধারণা “লাভ জিহাদ” এর ন্যারেটিভে রঙ চড়াতেই মিশরের এই ঘটনাটি ব্যবহার করা হয়েছে। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে। 

এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির দাবির সত্যতা যাচাই করতে আমরা ঐ ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি সংবাদ খুঁজে পাই। তার মধ্যে গত ৩ জুন ২০২৩ এ প্রকাশিত watanserb.com এর “The Owner of the image of the corpse on a motorcycle that worried the Egyptians! breaks his silence and reveals a surprise” শীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদ মারফত জানা গেছে যে, ঐ ছবিতে দৃশ্যমান মোটরসাইকেল চালকের নাম হচ্ছে মোহাম্মদ নাসের (Muhammad Nasr) এবং তিনি নিশ্চিত করেছেন যে একজন কাস্টমারকে একটি ম্যানেকুইন পৌঁছে দিতে তিনি একে মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মোহাম্মদ নাসের Cairo 24 নামক একটি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেন যে, “ছবিটি এত দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন।” তিনি আরও বলেন, অনেক শেয়ারকারী ঐ ছবিটিকে এমনভাবে বর্ণনা করছেন যে, একজন খুনী তার শিকারকে খুন করে মৃতদেহটি মোটরসাইকেলের পেছনে কাগজে মুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে – বাস্তবতার সাথে যার কোনোই মিল নেই

 

তাছাড়া, গত ২ জুন ২০২৩ এ প্রকাশিত Cairo 24 এর “After the publication of Cairo 24, the Ministry of Interior reveals the truth about a photo of a dead body on a motorcycle on a public road” শীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদ থেকে জানা গেছে, মিশরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিকিউরিটি সার্ভিস সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মোটরসাইকেলের ছবি সংক্রান্ত ঘটনাটির ব্যাপারে স্পষ্ট করেছে যে, ছড়িয়ে পড়া ছবিটি দোকানে কাপড় প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত একটি ম্যানেকুইনের, যা কিনা একজন রেডি-মেড কাপড়ের দোকানের মালিক একটি পরিবহন কোম্পানিকে অনুরোধ করেছিলেন তার দোকান থেকে কায়রোর মোকাত্তাম (Mukattam) নামক এলাকায় পৌঁছে দিতে। পরবর্তীতে ঐ ছবিতে দৃশ্যমান মোটরসাইকেল আরোহী পূর্বোক্ত রেডি-মেড কাপড় ব্যবসায়ীর দোকান থেকে ম্যানেকুইনটি সংগ্রহ করেন এবং সেটাকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে মোটরসাইকেলের পেছনে তোলেন বহন করার জন্য এবং তখন কোনভাবে ম্যানেকুইনের একটি পা আচ্ছাদনের বারে বের হয়ে আসে।

 

মিশরের এই ঘটনাটিকে ব্যবহার করে ভারতে একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো এবং সেই উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেল আরোহী এবং ম্যানেকুইনের ছবিকে একজন বিধর্মী প্রেমিক এবং হিন্দু মেয়ে দাবি করে পোস্ট শেয়ার করা হয়েছিলো। ভারতের বেশকিছু ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ঐ দাবিটিকে নাকচ করে দিয়েছে। অল্ট নিউজ, নিউজচেকার, এবং বুম ইন্ডিয়া এর ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টগুলো পড়ুন এখানে, এখানে, এবং এখানে

 

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির ক্যাপশনে সরাসরি লাভ জিহাদের কথা উল্লেখ ছিলো না। তবে, ছবিটি যেসকল পেইজে পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর নাম, যেমন: “হিন্দু শক্তি জাগো, লাভ জিহাদ রুখো” এবং “Love Jihad Intelligence Agency” থেকে অনুমিত হয় যে একটি ভিন্ন ঘটনাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে “লাভ জিহাদ” এর ন্যারেটিভ তৈরি করার প্রবণতা ঐ ছবিটির ক্যাপশনের মাঝে আছে। “লাভ জিহাদ” এর কাহিনী রচনা করে সামাজিক মাধ্যমে পূর্বে যেসকল পোস্ট শেয়ার করা হয়েছিলো সেগুলো পর্যালোচনা করে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। এই ধরণের কাহিনী রচনায় মূলত ভিন্ন একটি ঘটনার ছবি বা ভিডিও এবং কাল্পনিক নাম ব্যবহার করা হয় এবং প্রত্যেক কাহিনীতেই “লাভ জিহাদ” এর শিকার দেখানো হয় একজন হিন্দু মেয়েকে এবং শিকারী হিসেবে থাকেন একজন বিধর্মী বা মুসলমান যুবক। উল্লেখ্য, “লাভ জিহাদ” হচ্ছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর মাধ্যমে একটি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, যার সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। এই তত্ত্বের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, মুসলমান যুবকরা ছলাকলা দেখিয়ে হিন্দু মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে, গর্ভবতী করে, সম্পদ হাতিয়ে নেয়, এবং মুসলিম আধিপত্য নিশ্চিত করে। প্রায় প্রত্যেকটি “লাভ জিহাদ” এর ন্যারেটিভ সংবলিত পোস্টে দেখবেন ঐ একই জিনিস বলা হচ্ছে: মুসলমান যুবকের প্রেমের ফাঁদে পড়ে তাকে বিয়ে করে এখন পস্তাতে হচ্ছে হিন্দু মেয়েকে। তবে, মজার ব্যাপার হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো “লাভ জিহাদ” এর ধারণাকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস চালালেও অনেকেই একে একটি নিছক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বলে নাকচ করে দিয়েছে। তাছাড়া,  তাছাড়া, ২০১৮ সালে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন অ্যাজেন্সি (এনআইএ) ভারতের কেরালায় আন্তঃধর্মীয় বিয়েগুলো তদন্ত করে দেখে এবং সেখানে কথিত “লাভ জিহাদ” অর্থাৎ, পরিকল্পনা করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করার কোন প্রমাণ পায়নি। পড়ুন দি হিন্দুস্তান টাইমস এবং দি ওয়্যার এর প্রতিবেদন।

কিছুদিন আগে আনিকা বিক্রমণ নামক একজন মালায়ালাম অভিনেত্রীর মুখমন্ডলে আঘাতের চিহ্ন সংবলিত কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে দাবি করা হয়েছিলো যে মেয়েটির নাম অংকিতা বিজয় এবং সে আব্দুল নামক একজন মুসলমান যুবকের প্রেমে পড়েছিলো এবং ঐ যুবক তাকে জীবিত অবস্থায়ই নরক দেখিয়ে দিয়েছে নির্যাতন করে। ছবিগুলোর শেয়ারকারীরা এই ঘটনাটিকে “লাভ জিহাদ” এর পরিণতি বলে উল্লেখ করেছে। তবে, ফ্যাক্টওয়াচ সেই সময় সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিগুলোর দাবি যাচাই করে দেখেছিলো এবং একে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করেছিলো। ঐ ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টটি পড়ুন এখানে

অতএব, এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, ভিন্ন জায়গা এবং ঘটনার ছবি ব্যবহার করে বিধর্মী প্রেমিক কর্তৃক রাজস্থানের বিনীতাকে হত্যাচেষ্টার জন্য মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার দাবিটি সত্য নয়।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবির দাবিটিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh