মরিস বুকাইলি এবং ফেরাউন এর লাশ নিয়ে বিভ্রান্তি

Published on: August 31, 2022

Fact File 

সম্প্রতি ফেসবুক এবং ইউটিউবে ‘ফেরাউনের লাশ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নাস্তিক বিজ্ঞানী যেভাবে মুসলমান হয়ে গেলো’ শিরোনামযুক্ত একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে । অতীতেও বিভিন্ন সময়ে এই একই বিষয়  সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং জনমনে আলোচিত হয়েছে। সাম্প্রতিক এই ভিডিওতে ফরাসী লেখক ও চিকিৎসক মরিস বুকাইলি এবং মিশরের মমি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যেখানে একাধিক ভুল তথ্য খুজে পেয়েছে ফ্যাক্ট ওয়াচ।

গুজবের সুত্রপাতঃ

মানুষের মুখে মুখে এ সম্পর্কিত বিভিন্ন গুজব  দীর্ঘদিন থেকেই প্রচারে ছিল। ২০১৩ সালে, আরব নিউজ নামের একটি ওয়েবসাইটের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে অনেকেই এ সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহী হয়।

বাংলা ভাষায় এই গুজবটি নতুন করে ছড়াচ্ছে The Daily Moment নামের একটি পেইজ এর গত ২৪শে মে তারিখের একটি ভিডিও থেকে। ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন

The Daily Moment ছাড়াও আরো অনেকগুলো ফেইসবুক পেইজ এবং প্রোফাইল ভিডিওটি ডাউনলোড করে প্রচার করেছে।

 

এছাড়াও ইউটিউবে বিভিন্নভাবে এই একই গুজব ছড়িয়ে আছে।

 

 

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান 

ফেরাউন বা ফারাও শব্দটির আক্ষরিক অর্থ “মহান ঘর” বা “great house”। মিশরের প্রাচীন শাসকদের ফারাও বলা হত। ফারাও বা ফেরাউন কোনো একক ব্যক্তি নন, বরং বংশানুক্রমে একের পর এক ফারাও মিশরকে শাসন করেছেন।

তারা একাধারে শাসন এবং ধর্মীয় নেতা বা অবতার হিসেবে সম্মানিত হতেন।

অন্যদিকে , মরিস বুকাইলি (জন্ম: ১৯ জুলাই ১৯২০, মৃত্যু: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮), একজন ফরাসি চিকিৎসাবিদ। বুকাইলি ১৯৪৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মেডিসিন চর্চা করেন এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির উপর একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন । ১৯৭৩ সালে, বুকাইলি সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সালের পরিবারের চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হন। একই সাথে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের পরিবারের সদস্যরা তার রোগী ছিল। তিনি বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান বইটির জন্য বিখ্যাত হয়েছেন।

 

দাবি ১ঃ

ভিডিওর ন্যারেটর দাবি করেন “বর্তমানে ফেরাউনের মমি মিশরের দ্যা রয়াল জাদুঘরে একটি সাধারণ কাচের আবরণে রাখা আছে।“

 

খন্ডনঃ

মিশরের রয়াল জাদুঘরে মোট ২২টি মমি রয়েছে, যেখানে ১৮টি ফারাও, এবং ৪টি অন্য অভিজাতের মমি রয়েছে। ন্যারেটরের দাবিতে মনে হচ্ছে যে একটা মাত্র মমি আছে, কিন্তু দাবিটি অসত্য। দেখুন এখানে

 

দাবি ২ঃ

ন্যারেটর দাবি করেন “লাশটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কার করা হয়েছিল। বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত ফেরাউনের লাশের অবিকৃত অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে পারে নি”

 

খন্ডনঃ

আবিষ্কৃত লাশ অক্ষত বলাটা একটা অন্যায্য দাবি। মমিফিকেশন করা লাশের আভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গ সরিয়ে ফেলা হয়, সেগুলোকে ক্যানোপিক বয়ামে সংরক্ষণ করা হয়। শরীরে লবণ বা বালি দিয়ে আদ্রর্তা বের করে নেয়ার জন্য ৭০ দিন ফেলে রাখা হয়, এবং সবশেষে তাকে কাপড় নিয়ে আপাদমস্তক মুড়ে দেয়া হয়। পরে তার সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী নির্দিষ্ট কফিনে ঢুকিয়ে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়াটি একটি ধর্মীয় রীতি, এবং এটি বিজ্ঞান অনেক ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে। দেখুন এখানে

 

মমি তৈরির শিল্পের বয়স, এবং প্রকার বিজ্ঞানীরা অনেক ভালভাবেই জানেন এবং বুঝেন, প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উপায়ে মমি তৈরি হতে পারে। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার Chinchorro সংস্কৃতিতে লাশকে মমি বানানো হত ব্ল্যাক ম্যাঙ্গানিজ ব্যবহার করে, এবং এই প্রক্রিয়ার বয়স প্রায় ৭,০০০ বছর।

উত্তর আমেরিকার নেভাডায় আবিষ্কৃত মমির বয়স ১০ হাজার বছর বলে রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের ফলাফল এসেছে- যা লাইভ সায়েন্স প্রতিবেদন করেছিল।

সে তুলনায় মিশরের মমি বানানোর প্রক্রিয়া অত্যন্ত সাম্প্রতিক এবং উন্নত। মিশরের মমিদের সর্বোচ্চ বয়স ৩,৫০০ বছর।

(মমি বানানোর সহজ উপায় জানতে খান একাডেমির ভিডিওটি দেখুন)

 

দাবি ৩ঃ

ন্যারেটরের দাবি হচ্ছে “ফেরাউনের লাশ সংক্রান্ত গবেষক টিমের প্রধান ছিলেন মরিস বুকাইলি”।

 

খন্ডনঃ

ফেরাউনের লাশের সাথে মরিস বুকাইলির “দেখা” হয় ১৯৭৫ সালে, যখন কিনা লাশটি মিশরেই ছিল। ফ্রান্সে ফেরার পর মরিস বুকাইলি এই লাশের সাথে কোনো প্রকার গবেষণা কাজে জড়িত ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ আমরা পাই নি। বুকাইলির পরামর্শে ফেরাউনের লাশটি ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তিনি মমিটির অবস্থা শোচনীয় দেখতে পেয়ে ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা একে সাহায্য করতে পারবেন বলে মত দেন। মিশরীয়রা মমিটি দিতে না চাইলে ফরাসী প্রেসিডেন্টের অনুরোধে তারা সেই অনুমতি পান।

 

ফেরাউনের মমির ফরেনসিক গবেষণার দায়িত্বে ছিলেন Pierre-Fernand Ceccaldi, তিনি তার গবেষণা প্রকাশ করেন ১৯৮৭ সালে, Bulletin de l’Académie de Médecine- জার্নালে, Recherches sur les momies: Ramsès II শিরোনামে। বুকাইলির কোনো গবেষণা পত্রের সন্ধান আমরা পাই নি।

 

দাবি ৪ঃ

ন্যারেটর দাবি করেন “(বুকাইলি) কয়েক ঘন্টা গবেষণার পর ফেরাউনের লাশে লবণের কিছু অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায়। ফলে স্পষ্ট হয় যে সাগরে ডুবেই ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর তার লাশ সাগর থেকে উঠিয়ে এনে মমি করা হয়”

 

খন্ডনঃ

পূর্বের দাবি খণ্ডন করতে গিয়ে আমরা যেমন দেখেছি বুকাইলি এই লাশের গবেষণার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তো এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই জেনেও আমরা এই দাবিকে খণ্ডন করবো।

 

আগেই আমরা জেনেছি মমি তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে লবণ ব্যবহার করা হয়। লবণ মাংসে এবং চামড়ার আদ্রর্তা টেনে নেয় (যেভাবে শুটকি তৈরি করা হয়ে থাকে)। তার মানে ফেরাউনের লাশে লবণ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, বরং প্রয়োজনীয়ও!

 

এছাড়াও, ন্যারেটর দাবি করেন এই মমিটি থিবিসের একটি কবরস্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। অথচ মরিস বুকাইলি যে মমি উদ্ধারের সাথে জড়িত ছিলেন অর্থাৎ দ্বিতীয় রামেসিসের মমিটি উদ্ধার করা হয়েছিল দেইর এল-বাহারি বা দায়ের আল-বাহরী থেকে যা মিশরের লাক্সোর শহরের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।

 

ফরেনসিক রিপোর্টের মতে দ্বিতীয় রামেসিসের বয়স হয়েছিল ৯০ অথবা ৯১, তার শরীরের পুরোনো হাড় ভাঙার ক্ষত ছিল, বাতের সমস্যার ইঙ্গিত ছিল, আরেক গবেষকের মতে তার মৃত্যু হয়েছিল দাঁতের ক্ষয়ের ফলে মুখের সংক্রমণের কারণে।

Egypt Today এর এক প্রতিবেদন মতে  মিশরীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ Zahi Hawass একটি সেমিনারে ফেরাউনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন।

তিনি বলেন-

“সিটি স্ক্যান করে জানা সম্ভব নয় যে মমিটি ডুবে মারা গেছে কিনা। এটি প্রমাণ করার একমাত্র হল ফুসফুসে লবণ পাওয়া যায় কি না, কিন্তু ফুসফুস মমির ভিতরে পাওয়া যায় না। (মমি বানানোর সময়ে সকল আভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গ আলাদা বয়ামে রাখা হয়, শুধু হৃদপিণ্ডকেই পরে লাশের সাথে রাখা হয়- ফ্যাক্টওয়াচ।) যখন বিদেশি গবেষকরা আশির দশকে দ্বিতীয় রামসেসের মমি নিয়েছিল, প্রমাণ করার জন্য যে তিনি মুসার ফারাও ছিলেন, তখন একজন গবেষক ফ্রান্সে মমির চুল চুরি করে তার বাড়িতে একটি নিরাপদে রেখেছিলেন। গবেষক মারা গেলে, তার ছেলে সে চুল বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল।’

এছাড়াও এটি নিশ্চিত করা যায় যে দ্বিতীয় রামেসিসকে শুরুতে ভ্যালি অফ দ্যা কিংসে সমাহিত করা হয়েছিল, এবং পরে এখান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল দেইর এল-বাহারি বা দায়ের আল-বাহরীতে কারণ তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে মমির সাথে দেয়া উপঢৌকনের লোভে কেউ সেই সমাধিতে লুটপাট করতে পারে

 

দাবি ৫ঃ

ন্যারেটর দাবি করেন “বুকাইলি যখন ফেরাউনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে চুড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করছিলেন এবং তাতে এটা লিখেন যে ফেরাউন সাগরে ডুবেই মারা গেছে তখন উপস্থিত সঙ্গীদের মধ্যে একজন তাকে বললেন এ গবেষণার ফল প্রকাশে তাড়াহুড়া না করাটাই ভাল হবে, কারণ এ গবেষণার ফলাফল মুসলমানদের মতের পক্ষে যাচ্ছে”।

 

খন্ডনঃ

ফেরাউনের লাশের ফরেনসিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন Pierre-Fernand Ceccaldi, Bulletin de l’Académie de Médecine- জার্নালে, Recherches sur les momies: Ramsès II শিরোনামে। বুকাইলি এই গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন শুরুতে, কিন্তু মমিটি ফ্রান্সে আসার পরে তিনি এই গবেষণার সাথে ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। অথবা তার কথিত গবেষণা পত্রেরও কোনো খোঁজ আমরা পাই নি।

 

দাবি ৬ :  

ফেরাউনের লা*শ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে না*স্তিক বিজ্ঞানী যেভাবে মুসলমান হয়ে গেলো !!

 

খন্ডনঃ

মরিস বুকাইলি নাস্তিক ছিলেন কী না এর পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিংবা তিনি মুসলিম হয়েছিলেন কি না সেটিও তিনি কোথাও সরাসরি স্বীকার করেন নি।  ইসলামিক বুলেটিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-

তিনি দাবি করেন যে তিনি মনে করেন যে কুরআন স্রষ্টার বাণী, এবং মোহাম্মদ (সঃ) এর মাধ্যমে কুরআন মানবজাতির কাছে এসেছে, কিন্তু তিনি কোনো ধর্মের সাথে নিজেকে জড়াতে চান না।

এই নতুন মতবাদের নাম দেয়া হয়েছে বুকাইলিজম, বা বুকাইলিবাদ। অনেকে একে খ্রিস্টান ক্রিয়েশনিজমের মত একটা ভ্রান্ত মতবাদ বলে মনে করেন।

 

পাকিস্তানের দৈনিক ডন পত্রিকায় নাদিম এফ পারাচা বুকাইলির এইসব দাবির ব্যাপারে লিখেন

“বুকাইলি পশ্চিমা ও মুসলিম বিজ্ঞানীদের, বিশেষ করে মুসলিম বিজ্ঞানীদের কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন, যারা তাকে মুসলিম যুবকদের বিভ্রান্ত করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রচলিত অধ্যয়ন থেকে দূরে থাকতে প্ররোচনা দিয়েছেন বলে অভিযুক্ত করেন। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা এবং জীববিদ্যা সম্পর্কে যা কিছু জানার প্রয়োজন ছিল তার সব কিছু কুরআনে আছে দাবি করলে তরুণরা এসব বিষয় নিয়ে পড়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবে।

একজন ফরাসি খ্রিস্টান ডাক্তারের চমকপ্রদ দাবির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, খুব কম মুসলমানই এই সত্যটি জেনে সন্দিহান হয়েছিল যে তিনি সৌদি রাজতন্ত্রের বেতনভোগী ছিলেন। সৌদি রাজতন্ত্র ১৯৫০ এবং ১৯৭০ এর মাঝামাঝি  মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের  হুমকি থেকে এবং মুসলমানদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চাচ্ছিল”।

 

সারমর্মঃ

 

আলোচ্য ভিডিওতে কমপক্ষে ৬ টি ভুল দাবি খুজে পেয়েছে ফ্যাক্টওয়াচ ।  মিশরের প্রাচীণ মমি নিয়ে ডক্টর মরিস বুকাইলি গবেষণা করেছেন ঠিকই, তবে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh