ভাইরাল হওয়া ছবির বাবা ও মেয়ে কি মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন?

Published on: August 29, 2022

২০২০ সালের ১৮ই আগস্ট ময়মনসিংহের ফুলপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মাইক্রোবাস পুকুরে পড়ে শিশুসহ আটজন নিহত হয়েছিল। ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনাস্থলের একটি ছবি সেইসময় এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল যেখানে বলা হয়েছিল শিশুটিকে জড়িয়ে থাকা লোকটি তার বাবা এবং দুর্ঘটনায় তারা দুজনেই প্রাণ হারিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ছবিতে দেখা যাচ্ছে শিশুটির চাচাকে। উক্ত দুর্ঘটনায় নিহত শিশু বুলবুলি আক্তার (৭) এর বাবা শাহজাহান ও চাচা শারফুল আহত হলেও মৃতুবরণ করেন নি। উক্ত ছবিটি সম্প্রতি আবার “পিতা-কন্যা” পরিচয়ে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফেসবুকে সম্প্রতি শেয়ার হওয়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।

ছবিটির ক্যাপশনে বলা হচ্ছে,

“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।

ময়মনসিংহের ফুলপুরে মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় পুকুরে ডুবন্ত মাইক্রোবাস থেকে এভাবেই উদ্ধার করা হয় জড়িয়ে ধরা পিতা এবং তার রাজকন্যার মৃত দেহ। এমনকি নিজের শেষটা দিয়েও বাঁচাতে পারেননি তার রাজকন্যাকে।

বাবা রা এমন ই হয়।

আল্লাহ নিহতদের  জান্নাতবাসী করুক।

আমিন।“

 একইভাবে দুই বছর আগে, দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোর সাথে উক্ত ছবিটি বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। উপস্থাপনার ভঙ্গি এবং শিরোনামের ভিত্তিতে ছবিটি দেখে এমন ধারণা তৈরি হয় যে শিশুটিকে জড়িয়ে থাকা লোকটি তার বাবা এবং দুর্ঘটনায় তারা দুজনেই প্রাণ হারিয়েছে। এতে আবেগাপ্লুত হয়ে ফেইসবুকে অনেকেই ছবিটি শেয়ার করেন।

যেমন, দৈনিক ভোরের পাতার  ১৮ আগস্ট, ২০২০ অনলাইন সংস্করণের তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে- “ওই ঘটনার পর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন বাবা তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন। তবে তাদের ততক্ষণে প্রাণ চলে গেছে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ওই অবস্থায়ই তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।”

দৈনিক ইনকিলাব লিখেছে, “শিশু বুলবুলি আক্তার (৭) বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই মৃত্যু বরণ করেন। মাইক্রোবাস রাস্তার পাশের পানিতে ডুবে গেলে নিজ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রক্ষার শেষ চেষ্টা করে বাবা শাহজাহান। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আদরের মেয়েকে বুক থেকে ছাড়েননি এই বাবা। মৃত্যুর অন্তিম মূহুর্তে বাবা কন্যাকে ছেড়ে যায়নি। নিজের শেষ শক্তিটুকুও ব্যয় করে চেয়েছিলেন কন্যাকে বাঁচিয়ে তুলতে। অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে যাওয়া নিশ্চিত জেনে পরম মমত্ববোধে আগলে নিয়েছেন নিজের বুকে। বাবার বুকের মাঝেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মেয়েটি।”

এরকম খবর আরো পাওয়া যায় দৈনিক মাথাভাঙ্গা “বাবার বুকেই মারা গেলো ৫ বছরের বুলবুলি” এবং টাইম ভিশন-এ: “বাবার বুকে জড়িয়েই শেষ বিদায় নিলো বুলবুলি”।

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

উক্ত দুর্ঘটনা নিয়ে ভোরের কাগজের প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, ছবিতে যে ব্যক্তি শিশু বুলবুলির নিষ্প্রাণ দেহ জড়িয়ে ধরে আছে, তিনি মারা যাননি এবং তার নাম শারফুল। সম্পর্কে তিনি বুলবুলির বাবা নন, চাচা। দুর্ঘটনার পর শারফুল তার ভাতিজির মৃত লাশ নিয়ে আহাজারির দৃশ্যটি দেখে অনেকেই ভেবে নেয় তারা বাবা-মেয়ে। শরীফুলও নালিতাবাড়ীতে খালাতো ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন একই গাড়িতে করে।

ঢাকা অর্থনীতি নামের অনলাইন পত্রিকায় ১৯ এ আগস্ট ঐ ঘটনার একটি সংশোধনী প্রতিবেদন প্রকাশ করে “বাবা নয়, ভাতিজির লাশ বুকে নিয়ে চাচার আহাজারি”-এই শিরোনামে। সেখান থেকে জানা যায়, বুলবুলির পিতার নাম শাহজাহান। তিনিও ওই মাইক্রোবাসে ছিলেন। দুর্ঘটনার পর তিনি বেঁচে ফিরলেও বাঁচতে পারেনি মেয়ে বুলবুলি। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি ঢাকা অর্থনীতির প্রতিবেদকের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। শাহজাহান বলেন, “আমার ভাই শারফুল আমার শিশুকন্যা বুলবুলিকে পানি থেকে উদ্ধার করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখেন। কিন্তু আমার মেয়ে ততক্ষণে মারা গেছে। অনেকেই বাবা-মেয়ে বলে যা লিখছেন, তা ঠিক নয়।”

জাগো নিউজ থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, “বুলবুলির চাচা শারফুলের (৩৬) কোনো সন্তান নেই। এজন্য ভাই শাহজাহানের মেয়ে বুলবুলিকে নিজের মেয়ের মতো আদর-যত্ন করতেন চাচা শারফুল। নালিতাবাড়ী উপজেলায় খালাতো ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন তিনিও। একই গাড়িতে ছিলেন তারা সবাই।

দুর্ঘটনার পর জীবিত অবস্থায় ফিরে দেখেন আদরের ভাতিজিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। লাশ দেখেই আহাজারি শুরু করেন তিনি। বুলবুলির লাশ বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি। এই কান্নার দৃশ্য সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দৃশ্য দেখে সবাই মনে ভেবেছিলেন বাবা-মেয়ে। পরে জানা গেল চাচা-ভাতিজি।“

বিষয়টি নিয়ে সেইসময় ফ্যাক্টওয়াচ প্রতিনিধি বিভিন্ন সংবাদ মধ্যমে যোগাযোগ করলে, দৈনিক ভোরের পাতা ও নতুন সময়ে তথ্যের ভুল স্বীকার করে এবং সেগুলো সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেয়। যোগাযোগের কিছুক্ষণ পর নতুনসময় তাদের সাইট থেকে সংবাদটি সরিয়ে ফেলে, তবে দৈনিক ভোরের পাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদটি এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে।

মাইক্রোবাসের ভুয়া ছবি

প্রথম সারির  দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদনে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি কালো রঙের। অন্যদিকে, বৈশাখী নিউজ ২৪প্রবাসীর দিগন্ত একটি সাদা মাইক্রোবাসের ছবি জুড়ে দেয়, যার কোন উত্স উল্লেখ করা নেই। গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ দিয়ে এই সাদা মাইক্রোবাসের ছবিটির বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।

বৈশাখী’র প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি
ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবি

 

 

 

 

 

 

 

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

মূল দুর্ঘটনার তথ্য সঠিক হলেও দুর্ঘটনায় নিহত বুলবুলির বাবা শাহজাহান ও চাচা শারফুল আহত হলেও মৃতুবরণ করেন নি। আবেগতাড়িত অতিরঞ্জনের কারণে ছবি ও শিরোনামের ভিত্তিতে বুলবুলির সাথে সাথে তার বাবা-র মৃত্যুর কথা ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে দুর্ঘটনায় “মৃত বাবা ও মেয়েকে দেখা যাচ্ছে” এই দাবিটি ফ্যাক্টওয়াচ “আংশিক মিথ্যা” সাব্যস্ত করেছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh