Published on: July 18, 2021
সম্প্রতি দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট (ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট) ঢুকে পড়ার ফলে সংক্রমণের হার ভয়ংকর রূপ নিয়েছে এবং গত এক সপ্তাহ ধরে দৈনিক মৃত্যু একশ-র উপরে। এদিকে বাংলাদেশে এমন ১৫ লাখ মানুষ রয়েছেন, যারা অক্সফোর্ড-আ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন কিন্তু এখনো দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি। কোভিশিল্ড টিকার সংকট থাকায় এদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা স্বাস্থ্য অধিদফতর এখনও নিশ্চিত নয়। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশ টিকা আনার চেষ্টা করে এবং সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সরকারের হাতে এখন চীনের সিনোফার্ম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না এবং ফাইজারের মোট ৫৭ লক্ষ ডোজ টিকা রয়েছে। অন্যদিকে, সরকারের টিকা বিষয়ক ন্যাশনাল ইমুনাইজেশন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট গ্রুপ বা নাইটেগ টিকার মিশ্র ব্যবহার অর্থাৎ টিকার দুটি ডোজ দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে নি। এ অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাবনা কী? |
বাংলাদেশে টিকার মিশ্র ডোজ: সম্ভাবনা এবং গবেষণা
পহেলা জুলাই থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে আবারও করোনাভাইরাসের টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চীনের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের টিকা সারাদেশের ৪০টি কেন্দ্রে থেকে দেয়া হবে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের টিকাটি দেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র ঢাকার কয়েকটি কেন্দ্রে। বিস্তারিত পড়ুন এখানে।
তবে বাংলাদেশের যে ১৫ লাখ মানুষ অক্সফোর্ড-আ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি তাদের এখন টিকা দেয়া হবে না। কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নেয়ার পর ফাইজার বা সিনোফার্মের টিকা নেয়া নিরাপদ হবে কিনা সেটা গবেষণাধীন আছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, “ভ্যাকসিন মিক্স করা যায় কিনা সেটা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রিপোর্ট বেরিয়েছে। এইসব রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেবেন যে অন্যান্য দেশের মতো টিকার মিক্স-ম্যাচ আমাদের দেশে করা যাবে কিনা। সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদেরকে কোন টিকা দেয়া হবে না।”
তবে বিশ্বব্যাপী মিশ্র ডোজের সুপারিশ বাড়তে থাকায় বাংলাদেশেও এ নিয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আমরা বিবিসি নিউজ বাংলার বরাত দিয়ে জানতে পারি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এর পরিচালক তাহমীনা শিরীন স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং আইইডিসিআরের পক্ষে টিকার মিশ্র ডোজ ব্যবহারের গবেষণার জন্য একটা প্রোটোকল পত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। যাচাই-বাছাই এর পর সরকারি তহবিল পাওয়ার ভিত্তিতে গবেষণা শুরু হবে কিন্তু গবেষণার ফল পাওয়া সময় সাপেক্ষ হবে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
এ প্রসঙ্গে নাইটেগের সদস্য সচিব ড, বে-নজীর আহমেদ দেশের মধ্যে মিশ্র ডোজের গবেষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “এখানে ২/৩টা বিষয় আছে, প্রথমত এর কার্যকারিতা-দেখা গেল এর কার্যকারিতা ঠিক আছে, তারপর আসে এরফলে কোন জটিলতা হচ্ছে কীনা, তৃতীয়ত-এর স্থায়িত্ব কতটুকু! এই তিনটা প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত আপনি যখন সাধারণ জনগণকে কিছু দেবেন সেটা নৈতিকভাবে দিতে পারা যায় না।”
টিকার মিশ্র ডোজের সুরক্ষা বেশি: অক্সফোর্ডের গবেষণা
কম-কোভ ট্রায়াল নামের এই গবেষণায় উঠে এসেছে, দুইটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের টিকার সংমিশ্রণে মানুষের শরীরে কোভিডের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে। এমনটা হলে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের টিকার ব্যবহার আরও সহজ হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণাটিতে আরও জানা গেছে যে, যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ নিয়েছে, তারা যদি বুস্টার ডোজ হিসাবে তৃতীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠানের টিকা নেন, তবে সেটি তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। বিস্তারিত জানতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ২৮ জুন ২০২১ তারিখে প্রকাশিত “Mixed Oxford/Pfizer vaccine schedules generate robust immune response against COVID-19, finds Oxford-led study” শীর্ষক প্রেস রিলিজটি পড়ুন। বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যান্সেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি পড়ুন এখানে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই কম-কোভ পরীক্ষায় ৫০ বছরের বেশি বয়সী ৮৫০ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে:
- অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়ার পর যদি দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে ফাইজারের টিকা দেয়া হয়, তাহলে অ্যান্টিবডি ও টি সেল তৈরিতে বেশি কাজ করে। কিন্তু ফাইজারের টিকার পর অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া হলে ততটা উপকার পাওয়া যায় না।
- অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুইটি ডোজের তুলনায় এই দুই ধরনের টিকায় শরীরের বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
- ফাইজারের দুইটি ডোজের পর শরীরে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হতে দেখা গেছে। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পর ফাইজারের টিকা নেয়া হলে শরীরে সবচেয়ে বেশি টি সেলের তৈরি হয়েছে।
মিশ্র ডোজ টিকার পক্ষে জার্মানি
অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ফাইজার-বায়োএনটেক বা মডার্নার টিকা গ্রহণের প্রস্তাব করেছে জার্মানির টিকা কমিটি ‘The German Standing Committee on Vaccination (STIKO)’। ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ কমাতেও এ পদ্ধতি বেশি কার্যকর হবে বলে সুপারিশ তাদের। Robert Koch Institul থেকে ১ জুন ২০২১ তারিখে প্রকাশিত খসড়ায় লিখেছে, “according to current study results,” the immune response from a mixture of AstraZeneca with an mRNA vaccine was “significantly superior” to that from two doses of AstraZeneca.
তবে কিসের ভিত্তিতে এমন সুপারিশ আনা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলে নি সংস্থাটি। জার্মানির রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র জানিয়েছে এটি একটি খসড়া এবং পরবর্তীতে বিস্তারিতসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে। টিকার মিশ্র ডোজকে নিরাপদ বলে ধারণা করা হলেও গবেষকরা নিশ্চিত হতে তথ্য সংগ্রহ জারি রেখেছে। এ প্রসঙ্গে আল জাজিরার প্রতিবেদনটি পড়ুন।
এর আগে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল (৬৬) প্রথম ডোজ অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজে মডার্নার টিকা নিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাঁর মুখপাত্র বলেছেন, এ রকম মিশ্র ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলে সাধারণ মানুষ যাতে ভয় না পান সে কারণেই তাঁদের উৎসাহিত করতে চ্যান্সেলর নিজেই অক্সফোর্ড ও মডার্নার মিশ্র ডোজ নিয়েছেন।
একইসঙ্গে জার্মানিতে মিশ্র ডোজের সুপারিশ করা হয়েছে জানালে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, “জার্মানি করলেই আমরা করবো, তা নয়। এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ অন্য কোম্পানির দেওয়া যাবে এমন রিকমেন্ডেশন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফডিএ (যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) দেয়নি, সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোও কিছু বলেনি। সে ক্ষেত্রে আমরা জাতীয়ভাবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।“ পড়ুন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনটি।
সুতরাং সরকারের টিকা বিষয়ক ন্যাশনাল ইমুনাইজেশন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট গ্রুপ (নাইটেগ) টিকার মিশ্র ব্যবহার নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত জাতীয়ভাবে এ পদ্ধতির অনুসরণ নিরাপদ ভাবছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিলে আর কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন নাইটেগের সদস্য সচিব ড. বে-নজীর আহমেদ।
তথ্যসূত্র
কোভিড: বাংলাদেশে আবারও শুরু হয়েছে গণটিকা কার্যক্রম, টিকা পাবেন তিন ক্যাটাগরির মানুষ
Heterologous prime-boost COVID-19 vaccination: initial reactogenicity data
Germany recommends combining AstraZeneca, mRNA shots
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান। |