মাঙ্কিপক্স সমকাম থেকে উদ্ভূত কোনো রোগ নয়

Published on: May 24, 2022

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনটি ইউরোপীয় দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের একাধিক নমুনা পাওয়া গেছে। বৃটেনে এ পর্যন্ত পাওয়া প্রথম আক্রান্তদের মধ্যে চারজন পুরুষ রয়েছেন যারা সমকামী, উভয়কামী বা সেসকল পুরুষ (এমএসএম) যারা পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই বর্ণনা এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যেন রোগটি ইউরোপীয় দেশসমূহ, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই উদ্ভুত হয়েছে। এটি দুঃখজনকভাবে আরও মনে করিয়ে দেয় চল্লিশ বছর আগে এইডসে আক্রান্ত সমকামী পুরুষদের নিউমোসিস্টিস নিউমোনিয়া বিষয়ক একটি প্রতিবেদনের কথা। আদতে মাঙ্কিপক্স কোনো সমকামী রোগ নয় এবং কোনো সংক্রামক রোগও নয়। মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে আমাদের ধারণা দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি ইঙ্গিত করে যে, আমরা আগের মহামারী থেকে খুব কমই শিখেছি।

ছবিসূত্র: রয়টার্স

স্টিগমা প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে সবার ভেতর ভয় জাগিয়ে তোলে। এটি মহামারী প্রাদুর্ভাব বিষয়ক তদন্ত, সনাক্তকরণ এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণে গুরুতর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটি এইচআইভি সংক্রমণকে “সমকামীদের রোগ” বলাটা আশির দশকে সমকামীদের জন্য অকথ্য যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল। যার ফলস্বরূপ সেসময় এই রোগের জন্য সমকামীদেরই দায়ী করা হয়েছিল। এইডস মহামারী প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিনগুলোতে সনাক্তের হার কম ছিল, কারণ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিত্সা নেবার পরিবর্তে “সমকামী” হিসেবে চিহ্নিত হবার ভয়ে লোকলজ্জায় লুকিয়ে থেকেছেন। এর ফলে সংক্রমণ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত জানার, সংক্রমণের হার বোঝার এবং জরুরিভাবে এর বিস্তার রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল।

যখন জানা গেল যে, এইচআইভি সংক্রমণ সমকামী সম্প্রদায়ের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ নয়, কেবল তখনই এই সংকটকে মোকাবেলার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং অর্থসংস্থানের শুরু। চার দশক পরে, বর্তমানে এইচআইভি মহামারীর সংকটকে কার্যকরভাবে চিকিত্সাব্যবস্থা এবং প্রতিরোধ কৌশল দিয়ে মোকাবেলা করা গেছে।

দুঃখজনকভাবে, এই স্টিগমা দূর করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে এবং এইচআইভি মহামারিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। উদাহরণ স্বরূপ:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে, এইচআইভি মহামারীজনিত স্টিগমা কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক (স্পেনীয় সংস্কৃতির মানুষ) সমকামীদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসাধন করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সমকামীদের মধ্যে এইচআইভি’র প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হার কম, এইচআইভি সংক্রমণের হার বেশী এবং এইচআইভি সনাক্তে পরীক্ষা এবং চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতাও কম।

২০১১ সালে আমেরিকায় এইচআইভি/এইডস-এর ওপর পরিচালিত কায়সার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন এর একটি জরিপে দেখা গেছে, জরিপকৃত জনসংখ্যার ৪০% এখনও এইচআইভি এবং এইডস আক্রান্তদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ অনুভব করেন। এই বৈষম্য এখনও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে রয়ে গেছে যেখানে ৫৭% মানুষ এইচআইভি-পজিটিভ একজন ব্যক্তির দ্বারা তৈরি খাবার নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। সম্প্রদায়ের ৪৭% বিশ্বাস করেন সমকামী আচরণ অনৈতিক।

ছবিসূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (সিডিসি)

এইচআইভি মহামারীর সাথে সম্পর্কিত প্রাথমিক হোমোফোবিয়া (সমকামভীতি), এইচআইভি সবাইকে সমানভাবে সংক্রমিত করতে পারে – এই বার্তা দেয়ার বদলে লৈঙ্গিক ভিন্নতাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান করে। এটি ৯০ দশক এবং একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাপী এইচআইভি প্রতিক্রিয়া থেকে সমকামী পুরুষদের শুধু আড়াল করে দেয়নি, বিষমকামী লোকেদের মধ্যে মহামারী সম্পর্কে একটি ভিন্ন উপলব্ধিও তৈরি করে দিয়েছে।

একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি এমন স্টিগমা কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুতেও পরিলক্ষিত হয়েছিল। কোভিড সংক্রমণের উৎপত্তির জন্য চীন কে দায়ী করা এবং সর্বশেষ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের জন্য অযৌক্তিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর প্রতি বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এর অনন্য উদাহরণ। মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর নেতৃত্বে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মহামারি চলাকালীন বৈষম্য বা ঘৃণামূলক অপরাধের ভয়ে অ-হিস্পানিক শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর তুলনায় অ-হিস্পানিক এশীয় পরিবারগুলোর পর্যাপ্ত খাবার না থাকার অভিযোগ দ্বিগুণ ছিল। যেকোনো মহামারি শুরু হবার পর এধরণের ব্যাপারগুলো খুবই ক্ষতিকারক যা মানবিক দুর্যোগ মোকাবেলার স্বার্থে ভেঙ্গে ফেলা এখন সময়ের দাবী।

ছবিসূত্র: এনডিটিভি

মাঙ্কিপক্স এক ধরণের জুনোসিস (জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট রোগ যা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে)। সাধারণত এর সংক্রমণ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বনাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ঘটে। সম্প্রতি বছরগুলোতে উক্ত অঞ্চলে এবং উক্ত অঞ্চল থেকে ফেরত আসা ভ্রমণকারীদের মাঝে মানুষ-থেকে-মানুষে এই রোগ সংক্রমণের সীমিত সংখ্যক কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে সংক্রামিত ব্যক্তিদের থেকে দূষিত ফোমাইট বা শারীরিক তরলের মাধ্যমে এর সংক্রমণ ঘটতে পারে। এপ্রিল-মে ২০২২ সময়ে অনিয়মিত এবং পরিবর্তনশীল কিছু সংক্রমণের ওপর ভিত্তি করে এই ক্রমবর্ধমান মহামারীর জন্য সমকামিতা কে দায়ী করা শুধুমাত্র বিভ্রান্তিকরই নয় বরং যৌনতাকে ঘিরে নেতিবাচক বাঁধাধরা ভাবনাকেও উসকে দেয়ার সামিল।

ছবিসূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (সিডিসি)

যেহেতু আমরা ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় মাঙ্কিপক্সের চলমান প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে এখনও খুব বেশী জানি না, তাই কোনো বাছবিচার ছাড়া এখনি সংক্রমণের জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দায়ী করা উচিৎ নয়। বরং ভয় না দেখিয়ে জনগণকে সমর্থন ও নির্দেশনা প্রদান করা এবং সহানুভূতির সাথে জরুরী সাহায্যমূলক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনের উপর জোর দেয়া উচিত। পূর্ববর্তী এবং চলমান মহামারী থেকে আমরা যে কঠোর শিক্ষা পেয়েছি তা থেকে আমরা কীভাবে কোনও সম্প্রদায়কে অসাবধানতাবশত বিচ্ছিন্ন বা নেতিবাচক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না করে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা যায় এবং তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় তার ওপর মনোযোগ দিতে পারি। একইসাথে আমরা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কিত স্টিগমাগুলোকে ভেঙে ফেলতে পারি। মহামারীর ইতিহাস থেকে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে যেহেতু আমরা ইতিমধ্যে অনেকটাই অবগত তাই তা আরও ভালভাবে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া উচিৎ।

লেখক: 

১) ডা. বোঘুমা কাবিসেন টাইটানজি (এমডি, এমএসসি, পিএইচডি)
সংক্রামক রোগ চিকিৎসক এবং ভাইরোলজিস্ট
এমরি ইউনিভার্সিটি ইন আটলান্টা

২) ডা. কেলেটসো মাকোফেন
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী

ভাষান্তর: আপন দাস

মূল লেখাটি পড়ুন এখানে। 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply