সম্প্রতি নেপালে কোনো হনুমান-অবতারের জন্ম হয় নি

Published on: December 6, 2021

‘নেপালে শ্রীরাম ভক্ত  বজ্রংবলি হনুমানের মত লেজ আকৃতি নিয়ে এক শিশু জন্মগ্রহণ করেছেন’—এমন একটি স্ট্যাটাস ,এবং লেজযুক্ত একটি শিশুর ছবি ভাইরাল হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, যে ছবিগুলি ভাইরাল হয়েছে, সেগুলি ২০১৯ সালের বাংলাদেশের একটি শিশুর ছবি, যার লেজ সফলভাবে অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া , নেপালে সাম্প্রতিককালে এমন লেজযুক্ত কোনো শিশুর খবর পাওয়া যাচ্ছেনা।

গুজবের উৎস

২রা ডিসেম্বর রাত ৯ টা ১৪ মিনিটে সনাতন ধর্মাবলম্বী সারা বিশ্বের হিন্দু সমাজ গ্রুপে জনৈক শ্রী অসীম চন্দ্র বর্ম্মণ এই গুজবটি প্রথম পোস্ট করেন।

এরপর ৩রা ডিসেম্বর দিনভর এই গুজবটা ফেসবুকের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে, এখানে , এখানে, এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

এসব পোস্টে বলা হয়েছে- গত মঙ্গলবার নেপালে শ্রীরাম ভক্ত  বজ্রংবলি হনুমানের মত লেজ আকৃতি নিয়ে এক শিশু জন্মগ্রহণ করেন…

সনাতনী রীতি তে মানুষ জন্মান্তরে বিশ্বাসী ,আর আজকের মনুষ্যরূপ বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে…বৈজ্ঞানিক ভাবে যার সত্যতা প্রমান করেছেন বিজ্ঞানী ডারউইন

🌺🌺জয় শ্রীরাম🌺🌺


ছবির মূল উৎস

২০১৯ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের অনলাইনে এই শিশুটির ছবি পাওয়া যায়।

দৈনিক পূর্বকোণ, ঢাকা ট্রিবিউন ,বাংলাদেশ টাইমস সহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে সেই সময়ে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৩০শে মে এই শিশুটির জন্ম হয়েছিল ১৩ ইঞ্চি লেজ সহ। এরপর ১১ইজুন তারিখে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের কন্সালটেন্ট ডা. নজরুল ইসলাম আকাশের নেতৃত্বে একটি চিকিৎসক দল সফলভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুটির শরীর থেকে এই লেজ অপসারন করেন।

অপারেশনের পরে ডাক্তার নজরুল ইসলাম আকাশ নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্ট থেকে ছবিসহ একটি পোস্ট করেন।

ঢাকা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডাক্তার নজরুল ইসলাম আকাশ বলেছিলেন, এটা একটু বিরল ঘটনা, কিন্তু অপারেশনটা কোনো জটিল বিষয় নয়। এই লেজে কোনো হাড় ছিল না, স্নায়ু এবং মেরুরজ্জুর সাথে সংযুক্ত ছিল না। এই ধরনের লেজ মানবশরীরের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়।  আমি এই লেজটা এক্সরে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পরে নিশ্চিত হয়ে অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করেছি।

বাংলাদেশ টাইমসকে দেওয়া অন্য এক সাক্ষাৎকারে ডাক্তার নজরুল ইসলাম আকাশ বলেন, মানুষের শরীরে লেজ গজানো একটি বিরল ঘটনা। ১৯৫০ সালের পরে ৫০টির মতো রোগীর রিপোর্টিং হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এই প্রথম এ ধরনের ঘটনা ঘটলো।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, ২০১৯ সালের এই শিশুর ছবিগুলোর সাথে সাম্প্রতিক নেপালের কথিত ‘হনুমান অবতার’ এর ছবির হুবহু মিল দেখা যাচ্ছে। লেজের আকৃতি, চামড়ার রঙ, বাচ্চাটার শুয়ে থাকার ধরন ছাড়াও পরিধেয় কাপড়, বিছানার চাদর এর ডিজাইন পর্যন্ত হুবহু মিলে যাচ্ছে।


তবে ডাক্তার নজরুল এর মূল পোস্টে অপারেশনের পরে কর্তিত লেজের ছবি থাকলেও , ভাইরাল হওয়া গুজব পোস্টে কর্তিত লেজের ছবি নেই।

মূলত ডাক্তার আকাশের আপলোড করা ৫ টি ছবির মধ্যে ৩ টি ছবি ভাইরাল পোস্টে ব্যবহার করা হয়েছে।

নেপালে কি কোনো লেজযুক্ত বাচ্চার জন্ম হয়েছে?

অতীতে বিভিন্ন সময়ে ব্রাজিল ,ভারত সহ বিভিন্ন দেশেই এমন লেজযুক্ত শিশুর জন্মের খবর পাওয়া গিয়েছে।

ভারতে এমন লেজযুক্ত শিশুকে ‘হনুমান এর অবতার’ ভেবে পূজা করাও শুরু হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে

তবে বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিন ব্যাবহার করেও নিকট অতীতে নেপালে কোনো লেজযুক্ত শিশুর জন্মের খবর পাওয়া যায় নি ।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি ?

চিকিতসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ধরনের লেজকে বলে Vestigial Tail. বাংলায় আমরা একে ‘অপ্রয়োজনীয় লেজ’ বলতে পারি।  মানুষের শরীরে কিছু কিছু অংগ রয়েছে, যেগুলার কোনো কাজ নেই। এগুলা হল অপ্রয়োজনীয় অংগ , ভেস্টিজিয়াল অর্গান। (যেমন-আক্কেল দাত, এ্যাপেনডিক্স,শরীরের লোম ইত্যাদি) জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, বিবর্তনের কোনো এক পর্যায়ে মানুষের এই অংগ প্রত্যংগ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এখন আর প্রয়োজন নেই। তারপরেও এইগুলা আমাদের শরীরে এখনো রয়ে গেছে।

ভেস্টিজিয়াল টেইল ও হল সেই ধরনের লেজ, যা মানুষের শরীরে বর্তমানে অপ্রয়োজনীয়। গর্ভাবস্থায় সকল মানব শিশুর ভ্রুনেই লেজ তৈরি হয়। ৩১-৩৫ দিন বয়সে এই লেজ সবচেয়ে বেশি বড় থাকে । পরে এই লেজ মিলিয়ে যায় এবং তৈরি হয় Coccyx নামক শক্ত হাড়ের। আমাদের মেরুদন্ডের একেবারে শেষে অবস্থিত শক্ত ত্রিকোনাকার হাড়টাই হল এই কক্কিক্স ।

কিছু কিছু মানুষের জন্মগত ত্রুটির কারনে এই ভেস্টিজিয়াল টেইল বিলুপ না হয়ে আস্ত লেজ সহই জন্ম হয়। এই রকম ৪০ জনকে ডাক্তাররা খুজে পেয়েছেন এখন পর্যন্ত পৃথিবী জুড়ে। ভ্রূন অবস্থায় সকল মানব শিশুর শরীরেই লেজ থাকে। গর্ভাবস্থার অষ্টম সপ্তাহে এই লেজগুলো মেরুদণ্ডের শেষ অংশ  Coccyx এ বিলীন হয়ে যায়। তবে বিরল কিছু ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটির কারণে কিছু শিশু লেজসহই জন্মগ্রহণ করে। কমপক্ষে ৪০ জন এমন শিশুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। (বিশ্বব্যাপী এমন কয়েকজন ব্যক্তির কথা জানতে পারবেন এখানে )

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক তুষারকান্তি ঘোষ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন , মানুষের ভ্রূণের মধ্যে বিবর্তনের অনেকগুলি ধাপ রয়েছে। যেমন, ভ্রূণ অবস্থায় মানব হৃদপিণ্ড প্রথমে উভচরের মতো, তারপর সরীসৃপের মতো হয়। তারপর সেটা মানুষের হৃদপিণ্ডের রূপ নেয়। সেই রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলে অনেকের ভেন্ট্রিকিউলে ফুটো থেকে যায়।

একই রকমভাবে অনেকের হাতের আঙুল জোড়া থাকে বা বেশি আঙুল থাকে।

লেজও সেই রকম একটা বিচ্যুতি।

বানরের মতোই কোনো কোনো মানুষেরও ককসিক্স থেকে স্পাইনাল কর্ডের একটা অংশ প্রলম্বিত হয়। এতে তরণাস্থি এবং ‘নার্ভ টিস্যু’ থাকে। এমন উদাহরণ অবশ্য অত্যন্ত বিরল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবশরীরে যেটা দেখা যায়, তাকে বলা হয়, ‘সিউডো টেল’ বা ‘ছদ্ম-লেজ’। এর মধ্যে স্পাইনাল কর্ডের একটা অংশ সরাসরি জুড়ে থাকে না। এতে তরুণাস্থি এবং ‘নার্ভ টিস্যু’ থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। অনেক সময় শুধু মাংস-চামড়া-লোম আর কিছু ‘ফ্যাটি টিস্যু’ নিয়েই  লেজের মতো একটা অঙ্গ তৈরি হয়। এখানে (ভারতে) হদিস মেলা ছ’টি শিশুর একজনের লেজে ‘নার্ভ টিস্যু’  ছিল। সে লেজ নাড়তে পারত। বাকিদের শুধু মাংস-চামড়া-রক্ত ছিল, কিন্তু নার্ভ ছিল না। তাই তারা লেজ নাড়তে পারত না।

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন ,বাড়তি লেজ ছাড়া  এ সকল শিশুদের মধ্যে অন্য কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। হনুমান দেবতার বা অন্য কোনো অলৌকিক ক্ষমতার কথাও এসকল শিশুদের ক্ষেত্রে শোনা যায়নি। হাত পা বাঁকা,তালুকাটা, অন্ধ,বোবা সহ অনেক ধরনের জন্মগত ত্রুটি নিয়েই অনেক শিশু জন্মায়। ভেস্টিজিয়াল টেইল ও সেই ধরনের একটি জন্মগত ত্রুটি। এই ধরনের শিশুর সাথে অলৌকিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্য চিকিতসার মতই এই শিশুদেরকেও ডাক্তারের কাছে নিলে সঠিক চিকিতসার মাধ্যমে সূস্থ করা সম্ভব।

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

আলোচ্য ভাইরাল ছবিগুলো সত্য। লেজওয়ালা শিশুর ছবিতে কোনো ধরনের এডিট করা হয়নি। তবে এগুলো কয়েক বছর পূর্বের বাংলাদেশের একটি শিশুর ছবি। এটা সাম্প্রতিককালে নেপালের কোনো শিশুর ছবি নয় কিংবা নেপালে এমন ধরনের কোনো ‘হনুমানের অবতার’ এর জন্ম হয়নি। সার্বিক বিচারে ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply