হিমালয় থেকে ৩০০ বছরের বৌদ্ধ ভিক্ষু জীবিত উদ্ধার? – ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট

Published on: November 30, 2021

‘নেপালের কিছু আর্কিওলজিস্ট ও পুলিশ হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ি গুহা থেকে এক প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষুর শরীর উদ্ধার করেছে, তিনি এখনও জীবিত,বয়স আনুমানিক ৩০০ বছর এবং গত ২০০ বছর ধরে তিনি এভাবে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রয়েছেন’,  – এমন একটি পোস্ট গতকাল থেকে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনার কোনো সত্যতা নাই। এটি একটি ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট হিসেবে ফেসবুকে পোস্ট করা হচ্ছে। 

বিভ্রান্তির উৎস

মূলত ২৮শে নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই গুজব ছড়িয়ে পড়লেও , বাংলাদেশের বিভিন্ন পেজ,গ্রুপ এবং ব্যক্তিগত প্রফাইলেও এই সংক্রান্ত গুজব দেখা যাচ্ছে। ভাইরাল হওয়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, , এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

 

পোস্টে এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর ছবি দিয়ে বলা হয়, নেপালের কিছু আর্কিওলজিস্ট ও পুলিশের চালানো অভিযানে হিমালয়ের অত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ি গুহা থেকে একজন প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষু-কে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মেডিকেল টিমের পরীক্ষায় দেখা গেছে তার দেহে এখনও প্রাণ রয়েছে। তবে ফরেনসিক টিমের বক্তব্য অনুযায়ী এই বৌদ্ধ ভিক্ষু বর্তমানে সজ্ঞানে নেই, তার বয়স ২৫০ থেকে ৩০০ বছরের মধ্যে হতে পারে, এবং তিনি প্রায় দুশো বছরের ওপর ধরে এভাবে ধ্যানরত অবস্থায় রয়েছে। ধ্যানরত যোগীমূর্তির পাশ থেকে সাংকেতিক ভাষায় লেখা এক টুকরো কাগজ পাওয়া গেছে।

সেই সাংকেতিক ভাষায় লেখা কাগজটাই ব্যঙ্গের উৎস। কিছু পোস্টে বলা হচ্ছে যে ওখানে লেখা আছে “কাশফুল দিয়ে বালিশ বানানো যায় না”, আবার কোথাও বলা হচ্ছে যে লেখা আছে “যতবার ডার্বি, ততোবার হারবি”। কিছু কিছু জায়গায় অন্যান্য বার্তাও দেখা যাচ্ছে।

ছবির উৎস অনুসন্ধান

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে , ছবির এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর নাম Luang Phor Pian. আদি নিবাস কম্বোডিয়ায় হলেও তিনি থাইল্যান্ডে অবস্থিত একটি আশ্রমের ভিক্ষু ছিলেন। তিনি ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর ৯২ বছর বয়সে ব্যাংককের একটি হাসপাতালে মারা যান। তাকে সেন্ট্রাল থাইল্যান্ডের লোপবুরি প্রদেশে সমাধিস্থ করা হয়েছে, যেখানে তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় সেবা দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর দু’মাস পর ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের জন্য তাকে পরিষ্কার নতুন কাপড় পরাতে কফিন থেকে তোলা হয়। সেসময় মৃতদেহের এই শান্তিপূর্ণ হাসি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

ব্রিটিশ কিছু পত্রিকার এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে

বাংলাদেশের পত্রিকা The Financial Express-এর রিপোর্ট দেখুন এখানে

২০২০ সালে এই বৌদ্ধভিক্ষুর ছবিটি দিয়ে একটি ইন্টারনেট গুজব ছড়ায় যেখানে বলা হয় মঙ্গোলিয়ার উলানবাটোরে ১০০ বছর পর তার দেহ উদ্ধার করা হয়, তবে তার শরীরে প্রাণ রয়েছে। একে মিথ্যা প্রমাণ করে ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং সাইট Latestly একটি রিপোর্ট করে।

 

এদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে Sokushinbutsu-এর (সাধনাকালে জীবিত অবস্থায় মমিতে পরিণত হওয়া) প্রথা থাকলেও, ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করে নেপালে এরকম মমিকৃত ভিক্ষুর দেহ উদ্ধারের ঘটনা পাওয়া যায় নি।

কাশফুল দিয়ে বালিশ বানানো যায় না

পশ্চিমবঙ্গের কিছু রাজনৈতিক আলোচনা গ্রুপে ‘কাশফুল দিয়ে বালিশ বানানো যায় না’ এই বার্তা দিয়ে পোস্টটি করার কারণ হিসেবে জানা যায়, গত ১৮ই নভেম্বর হাওড়ায় এক প্রশাসনিক বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী পুজোর আগে বিপুল পরিমাণে ফোটা কাশফুল বালিশ বানানোয় কাজে লাগানো যায় কি না এমন প্রস্তাবনা দেন।

তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী পেজ/গ্রুপগুলো থেকেই ‘কাশফুল ফিয়ে বালিশ বানানো যায়না’ এমন বার্তা সম্বলিত পোস্ট বেশি দেখা গিয়েছে।

এছাড়া ‘সবাই শেয়ার করুন , নাহলে আপনার আগামী ৫ বছর খুব খারাপ যাবে’ বাক্যটির মধ্যেও রাজনৈতিক বার্তা আছে যেহেতু একবার নির্বাচনে ৫ বছরের জন্য জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন।

পাল্টা রাজনৈতিক ব্যঙ্গ

একই ছবি এবং ঘটনা জানিয়ে বিপরীত আরেকটি পোস্ট দেখা যাচ্ছে, তবে সেখানে বলা হচ্ছে, মূর্তির পাশের কাগজে লেখা ছিল- মোদী হয় তো মুমকিন হ্যায়, আচ্ছে দিন আয়েগা ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘আচ্ছে দিন আয়েগা’ হচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী’র রাজনৈতিক স্লোগান।

যতবার ডার্বি ,ততবার হারবি

একই শহরের দুইটা ফুটবল দলের মধ্যকার ম্যাচকে সাধারণত ডার্বি ম্যাচ বলা হয়। যেমন ,ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটির মধ্যকার ম্যাচকে ম্যানচেস্টার ডার্বি বলে। ইতালির এসি মিলান এবং ইন্টার মিলানের মধ্যকার ম্যাচকে মিলান ডার্বি বলে।

একইভাবে, কোলকাতার ঐতিহ্যবাহী দুই ফুটবল ক্লাব, মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল এর মধ্যকার ম্যাচকে কলকাতা ডার্বি বলে।

সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতা ডার্বিতে প্রায় একতরফাভাবে মোহনবাগান জিতে যাচ্ছে নিয়মিতভাবে। এ কারনে মোহনবাগান সমর্থকরা নিয়মিত ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের বিভিন্নভাবে ট্রল করছেন। আনন্দবাজারের এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে , ‘যতবার ডার্বি ততবার হারবি’ স্লোগানটি ২০১৮ সাল থেকে মোহনবাগান সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল।

সর্বশেষ গত শনিবার, ২৭শে নভেম্বর কলকাতা ডার্বিতে মোহনবাগান ৩-০ গোলে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে দিয়েছিল।


এসময় ফেসবুকে ‘যতবার ডার্বি, ততবার হারবি’ বার্তা সম্বলিত পোস্ট,ছবি এবং পোস্টার দেখা যেতে থাকে। একই সময়ে হিমালয়ের সন্ন্যাসীর পোস্টটি ভাইরাল হয়েছিল। অনেককে দেখা যায়, হিমালয়ের সন্ন্যাসীর চিরকুটে ‘যতবার ডার্বি ততবার হারবি’ স্লোগান সম্বলিত পোস্ট শেয়ার করতে।

বাংলাদেশে ভিন্ন স্লোগান

একই ছবি এবং পোস্টকে বাংলাদেশের ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপগুলাতেও শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন স্লোগান যুক্ত করা হয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা শিক্ষককদের আন্দোলনের দাবি সম্বলিত স্লোগান এসব পোস্টে দেখা গিয়েছে।


আবার , রাজনৈতিক স্লোগান বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ হাস্যকর কিছু বার্তাও অনেকে জুড়ে দিচ্ছেন এসব স্লোগানের জায়গায়।


‘দাচোকাবো’ বনাম ‘উল্টোনোলোটা’

কিছু কিছু পোস্টে বলা হচ্ছে,  নেপালের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী এই ধ্যানমগ্ন অবস্থাকে নেপালী ভাষায়  “উল্টানোলোটা” বলা হয়ে থাকে।

আবার কিছু পোস্টে বলছে, এই অবস্থাকে “দাচোকাবো” বলা হয়ে থাকে।

এগুলো কোনোটাই নেপালী শব্দ নয়।  দুটো শব্দই ট্রল কিংবা কৌতুক করতে ব্যবহৃত হয়। লোটা শব্দের অপর নাম -বদনা , যা প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। উলটানো লোটা শব্দটা দিয়ে মানব শরীরের বিশেষ অবস্থার সাথে বদনার তুলনা করা হয়েছে।

একইভাবে, ‘দাচোকাবো’ শব্দটা উলটোভাবে একটি গালাগাল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়।

শব্দগুলো কিংবা স্লোগানগুলোর সাথে পরিচিত সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা এসব পোস্টকে ইয়ার্কি / স্যাটায়ার/সারকাজম হিসেবে বুঝতে পারলেও অনেকেই কৌতুকটা বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

জনমনে বিভ্রান্তি

ধর্মভিত্তিক কয়েকটি গ্রুপের সদস্যদেরকে এ সম্পর্কিত পোস্টকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। যেমন- বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম গ্রুপে জনৈক অতিনু প্রসাদ বড়ুয়ার করা এই পোস্টে প্রথম ২০ ঘন্টায় ৫৮১ কমেন্ট এসেছে। এবং এদের মধ্যে প্রায় শতভাগ এটাকে অলৌকিক ঘটনা ধরে নিয়ে ‘সাধু সাধু’ মন্তব্য করছেন।


সনাতন ধর্ম ভিত্তিক কয়েকটি গ্রুপেও বৌদ্ধ ভিক্ষুর এই গুজবটিকে সত্য হিসেবে শেয়ার করতে দেখা গিয়েছে।

অন্যান্য ফ্যাক্টচেকারদের প্রতিক্রিয়া

গত ২৯শে নভেম্বর ফ্যাক্টক্রিসেন্ডো বাংলা এ সংক্রান্ত একটি ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে তারা ভাইরাল হওয়া দাবিটিকে ভুয়ো ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে উল্লেখ করেছে।


ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

ভাইরাল হওয়া এই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় নি। একই ছবি ব্যবহার করে অতীতে অন্যান্য ভাষাতে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এবারে বাংলা ভাষায় ছড়ানো এই গুজবে রাজনৈতিক মতাদর্শ সহ বিভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।  সামগ্রিক প্রকাশভঙ্গীর জন্য ফ্যাক্টওয়াচ একে ব্যঙ্গাত্মক হিসেবে সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply