নতুন গ্রেডিং পদ্ধতি দাবিতে প্রচারিত তালিকাটি আংশিক মিথ্যা

Published on: June 2, 2024

এসএসসি পরীক্ষায় প্রচলিত গ্রেডিং ভিত্তিক ফলাফলে পরিবর্তন এসেছে মর্মে একটি তালিকা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এই তালিকায় নম্বর এর বিপরীতে প্রচলিত গ্রেড বা জিপিএ’র বদলে কিছু বিশেষণ প্রদান করার দাবি করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে এই বিশেষণগুলো ব্যবহৃত হবে ঠিকই, তবে এর সাথে নম্বরের সম্পর্ক নেই। যে কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিকে আংশিক মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

গত ৩০শে মে ভোর ৫ টা ৩৩ মিনিটে মালীগাও উচ্চ বিদ্যালয় এডমিন নামক একটি পেজ থেকে এই তালিকাটি পোস্ট করতে দেখা যায়। ছড়িয়ে পড়া আরো কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হত। সাধারনত প্রতিটা বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা হত, এবং শিক্ষকরা ১০০ নম্বরের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মুল্যায়ন করতেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ( ম্যাট্রিক বা এসএসসি নামে পরিচিত) ১০ টি বিষয়ে মোট ১০০০ নম্বরের মধ্যে সর্বমোট নম্বর যুক্ত করে শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থান যাচাই করতেন । (সাধারণত ৭৫০ এর বেশি নম্বর পেলে তাকে ‘স্টার মার্কস’ বলা হত)

২০০১ সাল থেকে এই পদ্ধতির পরিবর্তন আসে। সে বছর থেকে মাধ্যমিক ( এস এস সি) পরীক্ষায় নম্বর এর সমতুল্য গ্রেড পয়েন্ট হিসাব করা শুরু হয়। সবগুলো বিষয়ের পরীক্ষার মোট ফলাফলে সর্বমোট নম্বরের বদলে গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (জিপিএ) গণনা শুরু হয়। এই গণনা পদ্ধতিটি নিম্নরুপ

২০২৫ সালের ডিসেম্বরে (অথবা ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে)) অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করতে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে ২০২৩ সাল থেকেই বিভিন্ন শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদান শুরু হয়েছিল।

 

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি:

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড  (National Curriculam and Textbook Board -NCTB) এর ওয়েবসাইটে, নতুন গ্রেডিং পদ্ধতি সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞপ্তি বা তথ্য দেখা যাচ্ছে না। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত, এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়নের কোনো নীতিমালাও এখানে দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রাথমিক স্তরের, ১ম,২য় ও ৩য় শ্রেণীর মূল্যায়ন নির্দেশিকা দেখা যাচ্ছে।

৩য় শ্রেণীর বাংলা বইয়ের মূল্যায়ন নির্দেশিকা থেকে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিকে অতি সরলীকৃত করে বোঝার চেষ্টা করা যাক।

১। এই পদ্ধতিতে প্রতিটা লিখিত প্রশ্নে/মৌখিক প্রশ্নে/ব্যবহারিক কার্যক্রমে কোনো নম্বর দেওয়া হবেনা, বরং Good/Very Good/ Excellent বা ভাল/খুব ভাল/অতি উত্তম এই ৩ টি ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হবে। এই প্রশ্ন বা কাজগুলোকে বলা হবে পারদর্শিতার নির্দেশক বা Performance Indicator (PI)

২। অনেকগুলো PI নিয়ে একটি PS ( Performance Strand বা পারদর্শিতার ক্ষেত্রে) গঠিত হবে । বিপরীতক্রমে বলা যায়, একটি PS এ অনেকগুলো PI থাকবে।

৩। প্রতিটি বিষয়ে একাধিক PS থাকবে । উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, তৃতীয় শ্রেণীর গণিত বিষয়ে ৫ টি PS রয়েছে। এগুলো হল গাণিতিক অনুসন্ধান, সংখ্যা ও পরিমাপ, আকৃতি, গাণিতিক সম্পর্ক, সম্ভাব্যতা । প্রতিটি পিএস থেকে শিক্ষক একাধিক পি আই নির্ধারণ করতে পারেন। পি আর ফলাফল ( গুড/ভেরি গুড/ এক্সিলেন্ট) গুলোকে সমন্বয় করে পিএস এর মূল্যায়ন , এবং ঐ বিষয়ের সামগ্রিক মূল্যাতন করা হবে।

৪।  নিচের এই স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে, একজন শিক্ষক বিভিন্ন পি আই এর বিপরীতে একটি ছকে তাঁর শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা চিহ্নিত করছেন Good,very Good বা Excellent হিসেবে (সংক্ষেপে G/V/E চিহ্ন দিয়ে)

৫। প্রতিটা PI তে মূল্যায়নের ক্যাটাগরি মাত্র ৩ টা , কিন্তু প্রতিটা PS এ মূল্যায়ণের ধাপ ৭ টা। এই ধাপ বের করার একটি গাণিতিক সূত্র রয়েছে।

.৬। কোনো পিএস এর অধীনে যতগুলো পিআই রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল অর্জন ( অর্থাৎ, এক্সিলেন্ট) অর্জনের সংখ্যা থেকে সবচেয়ে খারাপ অর্জনের সংখ্যা ( অর্থা গুড) বিয়োগ করতে হবে। এর পর মোট পি আই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে, সেটাকে শতকরায় রূপান্তর করলেই পারদর্শিতার ধাপ পাওয়া
যাবে।

এই পারদর্শিতার ধাপ হল শতকরা হিসেবে প্রকাশিত একটি সংখ্যা। এর মান -১০০ থেকে ১০০ পর্যন্ত যেকোনো ঋণাত্মক বা ধনাত্মক সংখ্যা বা শূন্য  হতে পারে ।

৭। পুরনো জিপিএ পদ্ধতির মতই, নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পারদর্শিতার ধাপ কে একটি বিশেষণে ভূষিত করা হচ্ছে ( পূর্বে যাকে গ্রেড এবং গ্রেড পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হত)। এই বিশেষণলো মোট ৭টি, যাদেরকে ‘পারদর্শিতার স্তর’ বলা হচ্ছে। এগুলো হল অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান, প্রারম্ভিক ইত্যাদি।

প্রতিটি পিএস এর বিপরীতে একটি পারদর্শিতার স্তর দেওয়া হবে। উদাহরণস্বরূপ, উপরের স্ক্রিনশটে, ‘যোগাযোগ’ নামক পিএস এ শিক্ষার্থী পেয়েছে ৪২.৫% , যা “অগ্রগামী” স্তরে রয়েছে। ৭ স্তরবিশিষ্ট পারদর্শিতার স্তরে এটি ৫ম স্তরে রয়েছে, তাই রিপোর্ট কার্ডে প্রথম ৫ টি স্তর চিহ্নিত করা হয়েছে ।

৮। এভাবে,চূড়ান্ত সনদে বা রিপোর্ট কার্ডে  শিক্ষার্থীর প্রতিটা বিষয়ের প্রতিটা পিএস এর বিপরীতে তাঁর অর্জন (পারদর্শিতা স্তর) চিহ্নিত করা থাকবে । তবে কোনো বিষয়ে একক পারদর্শিতার স্তর উল্লেখ করা হবে না । উদাহরণস্বরূপ, পুরনো গ্রেডিং সিস্টেমে , বাংলা পরীক্ষায় অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে মোট কত নম্বর শিক্ষার্থী পেয়েছে, তাঁর আলোকে একটি গ্রেড উল্লেখ করা থাকত। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে , মোত কোনো গ্রেড উল্লেখ না করে, প্রতিটি আলাদা পিএস এর বিপরীতে তাঁর পারদর্শিতার স্তর উল্লেখ করা থাকবে।

তৃতীর শ্রেণীর বাংলা বই ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের মূল্যায়ণ পদ্ধতি যাচাই করে দেখা গেল, সেখানেও একই পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে। এছাড়া, আজকের পত্রিকার এই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এর মূল্যায়ন কৌশল ও বাস্তবায়ন নির্দেশনা’ নামক প্রতিবেদনেও একই পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, যে প্রতিবেদনটি শীঘ্রই জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির সভায় চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

 

নতুন পদ্ধতিতে পিএস এর মূল্যায়নকে পুরনো পদ্ধতির গ্রেডিং এর সাথে তুলনা করা যাবে কি?

কয়েকটি বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় দুইটা পদ্ধতি তুলনা করা যাক। ধরে নেই, নতুন পদ্ধতির একটি পিএস পুরনো পদ্ধতির একটি পেপার এর সমতুল্য।

১। পুরনো পদ্ধতিতে ০ নম্বর পেলে ,কিংবা পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকলে ঐ শিক্ষার্থী এফ গ্রেড বা অকৃতকার্য হত।

নতুন পদ্ধতিতে, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদেরকে বিকল্প দিনে বা বিকল্প উপায়ে মূল্যায়ণ করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ের মূল্যায়ন নির্দেশিকার ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,  শ্রেণী কার্যক্রম চলাকালীন শিক্ষাথী আাংশিক সময় কিংবা পুরাটা সময় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে তাহলে ঐ শিক্ষার্থীকে ঐ যোগ্যতাটি অর্জন করানোর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাময়মূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

তবে কোনো শিক্ষার্থী কোনো পি আই এর বিপরীতে কোনো উত্তরই দিতে যদি না পারে, সেক্ষেত্রে তাকে গুড এর চেয়েও নিচে কোনো স্তর দেওয়া হবে কিনা, এই মূল্যায়ন নির্দেশিকা থেকে সেটা বোধগম্য হল না। যদি সকল ক্ষেত্রে গুড ই সর্বনিম্ন স্তর হয়ে থাকে, তাহলে পুরনো গ্রেডিং পদ্ধতির বদলে এটাকে আলাদা বলা যাবে।

২। পুরনো পদ্ধতিতে, ৮০% নম্বর পেলেই তাকে সর্বোচ্চ গ্রেড ( এপ্লাস) বলা হত। নতুন নিয়মানুযায়ী, কোনো পিএস এ ১০০% পি আই তে এক্সিলেন্ট পেলে তবেই তাকে সর্বোচ্চ গ্রেড (অনন্য) দেওয়া যাবে।

যেমন, কোনো পিএস এর আওতায় ৮ টি পিআই আছে। কোনো শিক্ষার্থী সবগুলো পি আই তেই এক্সিলেন্ট পেল, এবং এক্সিলেন্ট বাদে অন্য কোনো মাত্রা পেল না। ফলে তাঁর পারদর্শিতার ধাপ = (৮-০)/৮*১০০%=১০০%, এবং তাঁর পারদর্শিতার স্তর হবে অনন্য ।

অর্থাৎ, পুরনো পদ্ধতির গ্রেডিং এর সাথে নতুন পদ্ধতির পারদর্শিতার মাত্রায় পার্থক্য রয়েছে।

এছাড়া, চূড়ান্ত সনদে আলাদা আলাদা পিএস এর ফলাফল উল্লেখ পুরনো পদ্ধতির তুলনায় আলাদা। পুরনো পদ্ধতির লিখিত মূল্যায়ন পরীক্ষার বদলে নতুন পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষা এবং কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন রাখার সুপারিশ করা হয়েছে, যেদিক দিয়েও এটি আলাদা।


সিদ্ধান্ত:

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া তালিকায় নতুনভাবে মূল্যায়ণের জন্য যে নামগুলো ব্যবহার করা হয়েছে (অনন্য, অগ্রগামী ইত্যাদি), নতুন প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে সে নামগুলোই ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন শ্রেণীতে প্রচলিত মূল্যায়ণ পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে। তবে পুরনো আঙ্গিকে প্রাপ্ত নম্বরের সাথে সরাসরি এই পারদর্শিতার স্তর এর সম্পর্ক নেই। নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ণ হবে সম্পূর্ণ আলাদা রকমের। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ছড়িয়ে পড়া এই তালিকাকে আংশিক মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh