স্বতন্ত্র ইসলামী সেনাবাহিনী গঠন এর ভুয়া শিরোনাম ভাইরাল

Published on:[September 5,2021]

৫৭টি মুসলিম দেশকে নিয়ে ‘ইসলামি সেনাবাহিনী’ গঠন!—শিরোনামে একটি খবর ভাইরাল হয়েছে । প্রকাশিত খবরের শিরোনামে ‘ইসলামি সেনাবাহিনী গঠন’ এর কথা বলা হলেও, খবরের বিস্তারিত বিবরণে এমন বাহিনী গঠনের ‘প্রস্তাব’ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, ৩ বছর আগে তুরস্কের একটি স্থানীয় পত্রিকায় এমন বাহিনী গঠনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে তুরস্ক বা অন্য কেউ এমন কোনো বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করেনি কিংবা এমন কোনো মুসলিম সেনাবাহিনী গঠিত হয়নি।

বিভ্রান্তির উৎস

২৯শে আগস্ট দুপুর ১২টা ৩৭ মিনিট থেকে ‘ফেসবুকে ইসলাম প্রচার’ নামের একটি আইডি থেকে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে এই সংক্রান্ত একটি খবর শেয়ার করতে দেখা যায়। ( যেমন-এখানে , এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ।)



পরবর্তীতে, দেশ রিপোর্ট , প্রবাসি বাংলা নিউজ, ইসলামিক ওয়ার্ল্ড সহ বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপ এই খবরটা  শেয়ার করেছিল।

৫ টি ওয়েব পোর্টালে ( জেনে নিন, গাজী ২৪, লাইভ নিউজ ২০২১, আপডেট সংবাদ , ইসলামি ওয়ার্ল্ড ) এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল এসব পোর্টালের নিউজ লিঙ্ক শেয়ারের মাধ্যমেই ফেসবুকে এই গুজবটি ভাইরাল হয়েছে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

জেনে নিন ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, তুরস্ক প্রস্তাবিত ‘আর্মি অব ইসলামইসলামি সেনাবাহিনী নামে একটি যৌথ সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব করেছে তুরস্ক। গত ১৮ মার্চ দেয়া এই প্রস্তাব পশ্চিমা বিশ্বের নজর কেড়েছে। তুরস্কের পত্রিকা ‘ইয়ানি সাফাকেবিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।


অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে , এটি ১৮ই মার্চ এ প্রকাশিত কোনো একটি খবর। সমসাময়িক অর্থাৎ আগস্ট/সেপ্টেম্বর মাসের সাম্প্রতিক কোনো খবর নয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেল, সাম্প্রতিক ভাইরাল হওয়া খবরটির ভাষার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে ২০১৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত এই নিবন্ধের সাথে।

এছাড়া ২০১৮ সালের মার্চ মাসে একাধিক বাংলা পত্র পত্রিকায় এই সংক্রান্ত খবর দেখা গিয়েছিল। যেমন- দৈনিক ইনকিলাব, বাংলাদেশ প্রতিদিন , নিউজ ভিসন বিডি ,খুলনা টাইমস ইত্যাদি)

সবখানেই তথ্যসূত্র হিসেবে তুরস্কের স্থানীয় পত্রিকা ‘ইয়ানি সাফাক (yeni safak)’ কে উল্লেখ করা হয়েছে।

তুরস্কের ইংরেজিভাষী এই পত্রিকায় ২০১৭ সালের ১২ই ডিসেম্বর What if a Muslim army was established against Israel? শিরোনামে একটি মতামত/ সম্পাদকীয়  প্রকাশিত হয়।

লেখক এর নাম বিহীন এই সম্পাদকীয়তে বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে একটি ‘মুসলিম আর্মি’ গঠনের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওই সময়ে ইজরাইল প্রসঙ্গটি বিশ্বজুড়ে আলোচিত ছিল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সে সময়ে (২০১৭ এর ৬ই ডিসেম্বর) ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে পূর্ববর্তী তেল আবিব এর পরিবর্তে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেন। ও আই সি (ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) তখন (২০১৭ এর ১৩ই ডিসেম্বর) তুরস্কে একটি বিশেষ সম্মেলনের ডাক দেয়। রাজধানী স্থানান্তর এর পটভূমিতে ইজরাইলকে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক  কিংবা প্রয়োজনবোধে সামরিক পথে জবাব দেওয়ার বিভিন্ন সম্ভাব্য উপায় নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আলোচনা চলছিল তখন।

এরই পটভূমিতে yeni safak পত্রিকায় একটি ‘মুসলিম আর্মি’ গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়। এখানে দেখানো হয়, ও আই সি এর সদস্যভুক্ত ৫৭ টি দেশ যদি একটি একক ‘মুসলিম আর্মি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় , তবে সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া, এই নিবন্ধে ইসরাইলের সেনাবাহিনীর সাথে সম্ভাব্য মুসলিম আর্মির তুলনা করা হয়। এমনকি ইজরাইল দখলের সম্ভাব্য রুপরেখা নিয়েও আলোচনা করা হয়।

তবে ইয়ানি সাফাক এর এই নিবন্ধ ছাড়া অন্য কোথাও এমন কোনো মুসলিম আর্মি গঠনের পরিকল্পনা শোনা যায়নি। এমনকি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কিংবা ও আই সি’র তরফ থেকেও এমন কোনো পরিকল্পনার কথা কখনো জানানো হয়নি।

‘যাচাই ডট কম’ এর ফ্যাক্ট চেক

২০১৮ সালের মার্চ মাসেও এই খবরটি ভাইরাল হয়েছিল। ফ্যাক্ট চেকিং সাইট যাচাই ডট কম এ ২৬শে মার্চ এ সংক্রান্ত একটি ফ্যাক্ট চেকিং রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটিকে তারা ‘অসত্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা মন্তব্য করে, ৫৭টি দেশের নিজস্ব সম্মতি ছাড়া কোন একটি নির্দিষ্ট দেশ ওআইসির মাধ্যমে সেনা গঠন করার এখতিয়ার রাখে না। এটি কিছু মিডিয়ার এরদোগানকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে তুলে ধরার চলমান প্রচেষ্টা মাত্র। যার প্রভাবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মত দেশগুলোর নির্দিষ্ট কিছু মিডিয়া ক্রমাগত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের জয়জয়কার ও মহিমাকীর্তন করে প্রকাশ করে যাচ্ছে অসংখ্য বানোয়াট ও ভিত্তিহীন সংবাদ।

বর্তমান পরিস্থিতি কি ?

২০১৮ সালের পরে ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও সম্ভাব্য ‘মুসলিম আর্মি’ নিয়ে কোথাও কোনো নতুন আলোচনা হয়নি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান নিজের দেশের সেনাবাহিনীকে সমৃদ্ধ করছেন বলে জানা যাচ্ছে। ২০২০ সালের আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার বিতর্কিত নাগার্নো কারাবাখ এলাকার যুদ্ধে তুরস্কের সেনাবাহিনী অংশগ্রহণ করেছিল।

তবে তিনিও কোনো বক্তৃতা-বিবৃতিতে ‘মুসলিম আর্মি’ গঠনের কোনো পরিকল্পনার কথা জানান নি।

সিদ্ধান্ত

২০১৮ সালের গুজব নতুন করে ভাইরাল হওয়ায়, এবং গত ৩ বছরেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় ফ্যাক্টওয়াচ এই ভাইরাল খবরটিকে মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply