রবীন্দ্রনাথ কি নজরুলের লেখা চুরি করে নোবেল পেয়েছেন?

Published on: May 21, 2022

কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাঁর লেখা চুরি করে রবীন্দ্রনাথকে দিতেন এবং এসব লেখা দিয়েই রবীন্দ্রনাথ নোবেল জয় করেন- সম্প্রতি এমন একটি দাবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে কমপক্ষে তিনটি অসংগতি চিহ্নিত করা যাচ্ছে। দুইজনের সাহিত্যচর্চার সময়কাল, বিষয়বস্তু এবং নজরুলের বৈবাহিক জীবনের সময়কাল পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, নজরুলের লেখা চুরি করে রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয় বিষয়টি সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং মিথ্যা।

 

এমন কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

ভাইরাল দাবি

“কাজী নজরুল ইসলাম কে পরিকল্পিত ভাবে বিয়ে করানো হইছিল এক হিন্দু মেয়ের সাথে। সেই মেয়ে নজরুলের লেখাগুলো চুরি করে রবীন্দ্রনাথ কে দিত।

ঐসব চুরি করা লেখা দিয়েই ত রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাইলো

আর নজরুল যাতে এসব কথা প্রকাশ করে দিতে না পারে তাই তাকে ধুতুরা ফুল খাইয়ে পাগল করে রাখা হল সে হিন্দু মেয়ের সাহায্যেই!

এসব সত্য ইতিহাস আজ প্রকাশ করার সময় এসেছে!!”

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

রবীন্দ্রনাথের নোবেল

১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষায় সং অফারিংস নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই সংকলনের ভূমিকা লিখেছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি ডব্লু বি ইয়েটস। সেখানে গীতাঞ্জলিসহ সমসাময়িক বেশ কয়েকটি গ্রন্থের কবিতা রবীন্দ্রনাথ নিজে অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে এই ইংরেজি কাব্যগ্রন্থের কারণেই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি ১৫৭ টি গীতিকবিতার সংকলন। যেগুলো ১৯০৮-০৯ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে ১৯১০ সালে গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। এর বেশিরভাগ ছিলো ব্রাহ্মভাবাপন্ন ভক্তিমূলক কবিতা।

এছাড়া গীতাঞ্জলি সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন এখানে

 

নজরুলের সাহিত্য জীবন এবং বৈবাহিক জীবন

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালে। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি প্রকাশের এগারো বছর আগে। ১৯১৭ সালে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি করাচি সেনানিবাসে কর্মজীবন শুরু করেন। উইকিপিডিয়ায় দেওয়া তথ্যমতে, এই করাচি সেনানিবাসে থাকা অবস্থায়ই তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু হয়। অর্থাৎ, ১৯১৭ সালের পর তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু। নজরুলের প্রথম গদ্য “বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী” ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়।

এরপর ১৯২১ সালে প্রকাশক আলী আকবরের মাধ্যমে প্রমীলা দেবীর সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয় এবং পরবর্তীতে বিয়ে হয়। তবে এর আগে নার্গিস খানমের সাথে তাঁর আকদ হবার পর বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল।

পর্যালোচনা

প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। সে সময় নজরুলের বয়স ১১, কেবল তাঁর লেটো দল ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। নজরুলের সাহিত্যজীবনের শুরু হয় ১৯১৭ সালের পরে। অর্থ্যাৎ, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হবারও প্রায় সাত বছর পর থেকে নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের শুরু। অর্থাৎ, গীতাঞ্জলি প্রকাশের সমসাময়িক নজরুলের কোনো সাহিত্যচর্চার প্রমাণ নেই।

দ্বিতীয়ত, গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো ছিলো ব্রাহ্মভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা। অন্যদিকে সেসময় (গীতাঞ্জলি প্রকাশের সমসাময়িক সময়) নজরুলের পড়াশোনার বিষয়বস্তু ছিলো কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব। অর্থাৎ, দশ বছর বয়সী নজরুলের পড়ার বিষয়বস্তু এবং রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তৃতীয়ত, নজরুলের বৈবাহিক জীবন শুরু হয় গীতাঞ্জলি প্রকাশের কমপক্ষে দশ থেকে এগারো বছর পর। তাই কাজী নজরুলের স্ত্রীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের লেখা চুরি করা অসম্ভব।

পরিশেষে বলা যায় যে নজরুলের স্ত্রীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের লেখা চুরি বিষয়টি অবাস্তব। তাই ফ্যাক্টওয়াচ দাবিটিকে “মিথ্যা” চিহ্নিত করছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply