পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মিথ্যা দাবি বিএনপি মহাসচিবের

Published on: June 9, 2022

গত ৫ই জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন,  “পদ্মা সেতু কারো পৈত্রিক ব্যাপার না, এটা রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্ঠায় করা। পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর প্রথম স্থাপন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া” । নির্দিষ্ট কোনো দিন তারিখ উল্লেখ না করে তার এই ‘প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন’ এর দাবি অনলাইনে বেশ আলোড়ন তুলেছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এই তথ্যের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

গুজবের উৎস

 বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য-সম্বলিত কয়েকটি খবর দেখতে পাবেন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।




রোববার (৫ জুন) দুপুরে ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি মাওয়া পাড়ে এবং অপর পাড়ে – এই সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।’

বিএনপি’র ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে ৫ই জুন বিকাল ৪ টা ৫৯ মিনিটে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর এই বক্তব্য আপলোড করা হয়েছিল। তবে পোস্টের ক্যাপশনে কেবলমাত্র সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

বিভিন্ন সাধারণ জ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইটে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের তারিখ হিসেবে ২০০১ সালের ৪ জুলাই এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম দেখা যাচ্ছে।

এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে


দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ২০০১ সালের ৫ জুলাই সংখ্যায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের খবরটা পাওয়া যায় । সেখানে প্রথম পাতাতেই “পদ্মা সেতু নির্মিত হইলে গোটা দেশ সড়ক যোগাযোগের আওতায় আসিবে” শিরোনামে খবরটি ছাপা হয়।  এই খবরে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সুদীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বপ্নের সেতু-  পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করিবার পর আয়োজিত সমাবেশে বলিয়াছেন , বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মানের পর পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হইলে গোটা বাংলাদেশ একটি সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় আসিবে।‘’

সেই বক্তব্য এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের খবর তুলে ধরা হয়েছিল এই প্রতিবেদনে।

আলোকিত রাঙামাটি নামক অনলাইন পোর্টালে সাংবাদিক ওবায়দুল কবির সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন,

২০০১ সালের ৪ জুলাই, বুধবার। আষাঢ়ের শেষ বিকেলে বৃষ্টি ছিলনা। আকাশে ছিল ছেঁড়া মেঘ আর ভূমিতে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। এর মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ এসেছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক অসম্ভব স্বপ্নযাত্রার সাক্ষী হতে। পদ্মা সেতুর র্ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি। অসম্ভব মনে হচ্ছিল তখন অনেকের কাছেই। কেউ বলেছিলেন এটি শুধুই নির্বাচনী ঘোষণা। কারও মনে হয়েছিল স্বপ্নবিলাসী রাষ্ট্রনায়কের অলিক চিন্তা।

স্বপ্ন দেখার সেই দিনে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে আমিসহ ঢাকার বেশ কিছু সাংবাদিকও ছিলেন সাক্ষী। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে সেদিন এই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলাম আমরা।

তখন দেশে নির্বাচনের ডামাডোল। মাত্র কয়েকদিন পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ সরকার। চার দিকে জল্পনা কল্পনা- কে হচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। কারা হচ্ছেন এই সরকারের উপদেষ্টা। —-বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট তখন নানা অজুহাতে আন্দোলনের চেষ্টা করছে। এমন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে অর্থের সংস্থান ছিলনা। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, শীঘ্রই অর্থের সংস্থান করে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে।

সেদিন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। সেতুর বাস্তবায়ন কাল ধরা হয়েছিল ২০০৮। সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের পুরনো ফেরিঘাটে। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী চলে যান দুই কিলোমিটার দূরে কুমারভোগ চন্দ্রের মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সেই জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, জাপান সফরের সময় সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বাংলাদেশে দুটি সেতুতে অর্থ বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়েছি। একটি রূপসা এবং অপরটি পদ্মা। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অর্থ দিয়েছে। জাপান সরকারও অর্থের সংস্থানে আশ্বাস দিয়েছে। দুটি সাহায্য এখন আমাদের হাতে আছে। বাকি টাকাও সংস্থান হয়ে যাবে।

সার্চ ইঞ্জিন গুগলে ২০০১ সালের ৪ এবং ৫ই জুলাই তারিখে নির্দিষ্ট কি ওয়ার্ড সার্চ করে বাংলায় কোনো খবর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইংরেজিতে কেবলমাত্র স্টক ফটোগ্রাফি’র ওয়েবসাইট Alamay এর একটি এন্ট্রি পাওয়া গেল।

রয়টার্স এর আপলোড করা এই ছবির বিবরণীতে বলা হয়েছে,  BANGLADESH PRIME MINISTER SHEIKH HASINA PRAYS AFTER OPENING CONSTRUCTION OF A SIX KM BRIDGE NEAR DHAKA. Bangladesh Prime Minister Sheikh Hasina (2nd R) prays after she laid the foundation stone for the construction of a six km-long road and rail bridge on the river Padma, at Lauhajang near the capital Dhaka on July 4, 2001. The construction will start after completion of an ongoing feasibility study conducted by a Japanese firm. The $935 million bridge when completed by 2008 will be the longest bridge in Bangladesh and will connect the capital with the south and the southwestern parts of the country.

অর্থাৎ, এখানে, পদ্মা সেতুর নাম উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার অদূরে ৬ কিলোমিটার একটি সেতু উদ্বোধন করে মোনাজাত করছেন। ৪টা জুলাই ,২০০১ তারিখে ঢাকার অদূরে লৌহজং এ প্রধানমন্ত্রী ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু এবং রেল ব্রিজ এর উদ্বোধন করেছেন। চলতি ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ হলেই ব্রিজ সেতুর কাজ শুরু হবে। ৯৩৫ মিলিয়ন ডলার এর এই সেতুটা বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু হতে যাচ্ছে এবং ২০০৮ সালে উদ্বোধন এর পর এটি রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সংযোগ ঘটাবে।

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির সদস্য মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম রাসেল ৭ই জুন ২০২২ তারিখে পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের বেশ কিছু স্মারক এবং দলিলপত্র ফেসবুক একাউন্টে আপলোড করেন।  এখানে , ২০ আষাঢ় ১৪০৮ বঙ্গাব্দ / ৪ জুলাই ২০০১ সালে  বিকেল ১৬:৩০ মিনিটে পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র, শুভেচ্ছাবাণী এবং নামফলক দেখা যাচ্ছে।

তবে রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, একুশে সংবাদ এবং লন্ডন টাইমস নামক দু’টি অখ্যাত পোর্টালে ৬ই জুন তারিখে এই ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছিল।

সময় টিভি তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে  বিএনপি আমলের যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তাদের প্রস্তুতি ছিলো কিন্তু তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করতে পারেননি। অর্থাৎ  সময় টিভির অনুসন্ধানেও বেগম খালেদা জিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দাবি ভিত্তিহীন বলেই জানা যাচ্ছে। দেখুন এখানে

তাছাড়া এই গুজব প্রচারের বহু পূর্বেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অনেক সাংবাদিক কিংবা কলাম লেখক ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রতর স্থাপিত হয়েছিল বলে লিখেছেন। যেমন- ২০১৭ সালে বাংলা ট্রিবিউনে “পদ্মা সেতুঃ পরাজিত হল ষড়যন্ত্র” শীর্ষক কলামে সিআরআই এর পরিচালক আশরাক সিদ্দিকী বিটু জানান,  সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ১৯৯৮-৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রিফিজিবিলিটি সম্পন্ন করে  এবং ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল।

গত ২৪শে মে সময়ের আলো নামক অনলাইন পোর্টালে রাজউক এর সাবেক চেয়ারম্যান আর কে চৌধুরী তার লেখা পদ্মা সেতুর টোল সাধ্যের মধ্যে রাখুন শীর্ষক কলামেও একই কথা জানান।

১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও সে সময়ে পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের কোনো খবর   অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানার ও অনুসন্ধান চালিয়েছে এবং তারাও মির্জা ফখরুল এর এই দাবিকে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা হিসেবে সনাক্ত করেছে।

সুতরাং পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে বিএনপি মহাসচিবের এই দাবি ভিত্তিহীন। ফ্যাক্টওয়াচের
অনুসন্ধান এইসব তথ্যের কোন সত্যতা না  পেয়ে এটাকে মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply