প্যারাইডোলিয়া কি এবং কেন?

Published on: [July 22,2021]

জহিরুল ইসলাম

 

দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আজ সকাল থেকে ‘কোরবানির মাংসে আল্লাহ’র নাম’ শিরোনামে বিভিন্ন খবর এবং ছবি পাওয়া যাচ্ছে। গরুর মাংসের আকাবাকা ফাইবার এবং চর্বির সাথে আরবিতে আল্লাহু শব্দের সাদৃশ্য নিয়ে এসব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এমন খবর পাওয়া গেছে ফরিদপুরে , ভোলায় , চাদপুরে সহ বিভিন্ন জায়গায়।

অতীতেও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন ‘আল্লাহু’ লেখা মাংসের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। এমন কিছু পুরনো খবর দেখুন এখানে , এখানে , এখানে, এখানে , এখানে। গরুর মাংস ছাড়াও চিংড়ি মাছ , মাছের ডিম কিংবা গাছের ডালেও  অনেকে আল্লাহ’র নামের সাদৃশ্য খুজে পেয়েছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে , এসব মাংসের মধ্যে পাওয়া প্রতীকের সাথে “আল্লাহু” শব্দের সাথে যতটা সাদৃশ্য রয়েছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করছে এক ধরনের মানসিক বিভ্রম। মানুষের মস্তিষ্কের একটা প্রবণতা হল, মানুষ এলোমেলো কিছু জিনিসের মধ্যে থেকে পরিচিত প্যাটার্ন খুঁজে বের করে। এই প্রবণতাকে মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় প্যারাইডোলিয়া (Pareidolia) বলে।

এই Pareidolia শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দ para (পরিবর্তিত, পাশাপাশি) এবং eidolon (ছবি, আকৃতি) নিয়ে গঠিত। সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত বিষয় থেকে অর্থপূর্ণ কোনো ইঙ্গিত খুঁজে নেয়ার এই প্রবণতার নামই হল প্যারাইডোলিয়া (Pareidolia)।

দুইটা বিন্দু বা ছোট বৃত্ত পাশাপাশি থাকলেই আমরা সেটাকে মানুষের চোখ মনে করার চেষ্টা করি। দুই চোখের মাঝে লম্বা একটা দাগ থাকলে তো কথাই নাই, নাক-চুোখ মিলিয়ে আস্ত একটা মানুষ বানিয়ে ফেলি।

এই ব্যাগের সাথে মানুষের মুখের সাদৃশ্য খুজে পাচ্ছেন ? ইমেজ সোর্স

প্রাচীণকালের জ্যোতিষীরা আকাশের তারা দেখে দেখে সেগুলোর মধ্যে বাঘ ,সিংহ, শেয়াল, ভাল্লুক, কাঁকড়া ইত্যাদি বিভিন্ন আকৃতির প্যাটার্ন খুঁজে বের করতেন। সেই প্যাটার্ন থেকেই আকাশের তারকামন্ডলী/রাশিচক্রের নাম রাখা হয়েছিল মেষ (ভেড়া, বৃষ (মহিষ), সিংহ, কর্কট (কাঁকড়া) ইত্যাদি ।

সবচেয়ে কমন প্যারাডোলিয়া দেখা যায় আকাশের মেঘের মধ্যে । মেঘের বিভিন্ন প্যাটার্নের মধ্যে হাতি, বিড়াল, মানুষ — বহু কিছুর মিল খুঁজে পাই । “পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ” জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা, যে শিরোনামে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানও একখানা বই লিখেছেন।

আকাশে ডানাওয়ালা পঙ্খীরাজ ঘোড়া উড়ছে ? নাকি এটা জাস্ট মেঘ ? ইমেজ সোর্স

 

আকাশে উড়িতেছে একপাল হাতি ! দেখতে পাচ্ছেন ? ইমেজ সোর্স
শুধুই মেঘ ? নাকি প্রেমের দেবতার পাঠানো কোনো সিগনাল ? ইমেজ সোর্স
যীশু ক্রুসবিদ্ধ হয়ে আকাশে চলে গেছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। দেখা যাচ্ছে তাকে? নাকি এটা শুধুই মেঘ? ইমেজ সোর্স

রাতে , কম আলোতে  এলোমেলোভাবে রাখা কম্বল বা কাপড়চোপড় দেখে  ভয় পেয়ে চমকে উঠি। ভাবি , ওখানে কি কোনো মানুষ বসে আছে !

অনেক সময় ধর্মীয় আবেগের বশে অনেকে এলোমেলো জিনিসের মধ্যে ধর্মীয় ছবি খুজে পান। যীশুর ছবি, ভার্জিন মেরির ছবি , ত্রিশুলের ছবি বা আরবিতে “আল্লাহু” শব্দের সাথে অনেকে অনেক জায়গায় মিল খুঁজে পান। এগুলা সবই প্যারাইডেলিয়া । এর মধ্যে অলৌকিকতা বা আর কোনো কিছুর সম্পর্ক নাই।

গরুর গায়ে সংস্কৃত ওম শব্দটা দেখা যাচ্ছে কি ? ইমেজ সোর্স
খ্রিষ্টধর্মের প্রতীক ক্রস সম্বলিত ‘Holy Cow’! ইমেজ সোর্স
আরবিতে আল্লাহর নাম সম্বলিত গরু। ইমেজ সোর্স

একই কথা প্রযোজ্য গরুর মাংসের মধ্যে আল্লাহু নামের ক্ষেত্রেও । নির্দিষ্ট এ্যাঙ্গেলে তাকালে এই মাংসের অংশবিশেষের সাথে আরবিতে   اللّٰه‎  (Allah) শব্দটার মিল পাওয়া যায়।

আবার হিন্দু ধর্মের প্রতীক ত্রিশুলের সাথেও মেলানো যায় প্যাটার্নকে।

হাতের আঙ্গুলের সাথেও মেলানো সম্ভব।

ক্রিকেটের ৩ টা স্ট্যাম্পের সাথেও মেলানো সম্ভব।

কুণ্ডলি পাকানো সাপও দেখতে পারেন অনেকে।

এই দেখার ব্যাপারটা যার যার ব্যক্তিগত, ধর্মীয় বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রভাবিত হয়।


 

কেন ঘটে প্যারাইডোলিয়া?

ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির ক্রিস্টোফার ফ্রেঞ্চ জানান, প্যারাইডোলিয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে লাখ লাখ বছর আগের প্রাচীন মানুষদের মধ্যে। তাদের বেঁচে থাকার জন্যেই এটি প্রয়োজনীয় ছিল। প্রতিকূল পরিবেশে থাকার কারণে বিভিন্ন চিহ্ন দেখে তাদের হিংস্র প্রাণী থেকে সতর্ক থাকতে হতো। মাটির কোনো দাগকে বাঘের পায়ের ছাপ মনে হলে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করতে হতো। কিংবা কোনো ঝোঁপঝাড় দেখে হঠাৎ হিংস্র পশু বলে মনে হতো। প্রাচীন মানুষের বুদ্ধিমত্তা তখনও পরিণত না হওয়ায় এসবকেই তারা বিপদের লক্ষণ বলে ধরে নিতো, যার ফলে প্রতি মুহূর্তে আরও সতর্ক থাকতে পারতো।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নুচিন হাজিখানির মতে, এটি বিবর্তনের ফল। জন্ম থেকেই মানুষ এরকম বিশেষ কিছু প্যাটার্ন শনাক্ত করতে বিশেষভাবে অভ্যস্ত। এসব ক্ষেত্রে নিজের বিশ্লেষণী ক্ষমতাও তেমন কাজে লাগায় না মস্তিষ্ক, অত্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। হোক তা ঠিক বা ভুল।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের নিউরোসায়েন্টিস্ট সোফি স্কটের মতে, প্যারাইডোলিয়ায় মানুষের আশা-আকাঙ্খারই প্রতিফলন ঘটে। যে ব্যক্তি যে ধরনের চিন্তা বেশি করে, সে সেই ধরনের প্যারাইডোলিয়া বেশি দেখে। যে পশুপাখি ভালোবাসে, সে মেঘের মধ্যে “সোনার সিংহ” দেখে। যে ধার্মিক, সে টোস্টে যিশুর ছবি দেখে।  এখানে প্রকৃতির কৃতিত্ব যতটা, তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব মানুষের স্বভাব-চরিত্রের।

কোরবানির মাংসে আল্লাহু নামের সাথে যে মিল পাওয়া যাচ্ছে, তেমন মিল বেশ সাধারণ ঘটনা। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে অনেকে এমন মিল খুজে পেয়েছেন। এটি কোনো অলৌকিক বিষয় নয়। প্যারাইডোলিয়ার বিষয়টি মনে রাখলে এসব দৃশ্যগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply