পিরিয়ড চলাকালীন “চারটি কাজ” বর্জন করার দাবিটি ভিত্তিহীন

Published on: November 27, 2021

‘পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে নিচের চারটি কাজ অবশ্যই বর্জন করুন’ – এমন একটি পোস্ট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বর্জন করতে বলা চারটি কাজের মধ্যে আছে – ঠাণ্ডা পানি, নারকেল, শসা খাওয়া, শ্যাম্পু ব্যবহার না করা এবং পেটে শক্ত কিছুর আঘাত না লাগা। এতে করে মাথা ব্যথা, বন্ধ্যাত্ব এবং ক্যান্সার হতে পারে বলে দাবি করছে এই সব পোস্ট। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

বিভ্রান্তির উৎস

ভাইরাল হওয়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে. এখানে. এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

৯ নভেম্বর, ২০২১ তারিখ ‘মায়া’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে দুপুর ১টা ৫১ মিনিটে নিচের পোস্টটি আপডেট করা হয়। এটি কমপক্ষে ১৪০০ বার শেয়ার হয়।

সেদিন রাত ৮টা ৫৪ মিনিটে Talukdar Monsur নামক একটি ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে ‘নতুন ডিজাইন কালেকশন ও শখের হাতের কাজ’ এই পাবলিক গ্রুপটিতে একই পোস্ট করা হয়।

পরবর্তীতে ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ, প্রোফাইল এবং গ্রুপে পোস্টটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।


ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এ পোস্টের সবচেয়ে পুরনো উৎস হিসেবে ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত DPRC Hospital-এর অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট পোস্ট করা একটি ভিডিওচিত্র পাওয়া যায়। ভিডিওটিতে উল্লেখিত পোস্টের ৪টি পয়েন্ট উপস্থাপন করা হয়।

তবে এটি মূলত আরও আগের ইন্টারনেট গুজব। ২০১৩ সালের মে মাসে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় গুজবটি প্রথম ছড়ায়, যদিও সেখানে ৪টির মধ্যে ৩টি পয়েন্টের উল্লেখ ছিল। ২০১৮ সালের মাঝমাঝি পর্যন্ত ইন্টারনেটে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ ও ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় এ গুজব ছড়ায়। ইতোমধ্যে কয়েকটি ফ্যাক্টচেকিং সাইট এর সত্যতা যাচাই করে ফেলেছে।

এএফপি ফ্যাক্টচেকিং সাইট ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর এই গুজবটির সত্যতা যাচাই করে একটি রিপোর্ট করে। সেখানে গাইনোকোলোজিস্ট Anaïs Reyes Navarro এবং রিপ্রোডাকশন স্পেশালিস্ট Kiyoshi Macotela Nakagaki-এর পরামর্শ তুলে ধরা হয়। সে অংশটি এখানে অনুবাদ করে দেওয়া হলো।

 

দাবি ১। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে ঠান্ডা জল, কোমল পানীয় এবং নারিকেল খাবেন না।

এ প্রসঙ্গে Dr. Anaïs Reyes Navarro-এর মতে, এর মধ্যে কোনটিই শরীরের হরমোনাল সাইকেল বদলে দেয় না এবং নারীর প্রজননতন্ত্রজনিত কোনো রোগের ঝুঁকি বাড়ায় না।

Dr. Kiyoshi Macotela Nakagaki বলেন, ‘নারিকেল এবং ঠাণ্ডা পানি খাওয়ার সাথে বন্ধ্যাত্ব এবং ক্যান্সারের ঝুঁকির কোনো সম্পর্ক নেই। এই দাবির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’

দাবি ২। এইসময় মাথায় শ্যাম্পু ব্যাবহার করবেন না। কারণ পিরিয়ডের সময় চুলের গোড়া আলগা হয় ফলে লোমকূপ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। শ্যাম্পু ব্যবহার এসময় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।

Dr. Anaïs Reyes Navarro-এর মতে, পিরিয়ডের সময়কার মাথাব্যথা প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিন্ড্রোমের সাথে সম্পর্কিত। প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম হচ্ছে পিরিয়ডের সময় হরমোনের তারতম্যের কারণে তৈরি উপসর্গ।  প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিনড্রোমের আরো কিছু উপসর্গ হচ্ছে সংবেদনশীল স্তন, মুড সুইং এবং তলপেট ব্যথা।

Dr. Kiyoshi Macotela Nakagaki-এর মন্তব্য – ‘আমার কিছু বলার নেই, শুনে ইয়ার্কি মনে হচ্ছে।’

দাবি ৩। এইসময় শশা খাবেন না। কারণ শশার মধ্যে থাকারস পিরিয়ডের রক্তকে জরায়ু প্রাচীরে আটকে দিতে পারে। যার ফলে আপনার বন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

Dr. Anaïs Reyes Navarro : এখানেও কোনো সম্পর্ক নেই।

Dr. Kiyoshi Macotela Nakagaki : বন্ধ্যাত্বের অনেক রকম কারণ থাকতে পারে, যেমন ডিম্বস্ফোটনের পরিবর্তন এবং যৌনতার সমস্যা। কিন্তু শসা খাওয়া একটি কারণ নয়।

US National Institute of Child Health and Human Development (NICHD)-এর রিপোর্ট অনুসারে, নারীর বন্ধ্যাত্বের সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে – ডিম্বস্ফোটন না হওয়া, মেন্সট্রুয়াল চক্রের সমস্যা, প্রজননতন্ত্রের গঠনগত সমস্যা, ইনফেকশন, ডিম্বের পরিপক্ব হবার ব্যর্থতা, ইমপ্ল্যান্টেশনে ব্যর্থতা, এন্ডোমেট্রিওসিস, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, প্রাইমারি ওভারি ইনসাফিসিয়েন্সি, ইউটেরিন ফিব্রয়েড, অটোইমিউন ডিসঅর্ডার। সেখানে শসা থেকে বন্ধ্যাত্ব হবার কোন উল্লেখ নেই।

 

দাবি ৪। এছাড়াও লক্ষ্য রাখবেন, পিরিয়ডের সময় যেন শরীরে শক্ত কিছুর আঘাত না লাগে, বিশেষত পেটে। পিরিয়ডের সময়টায় জরায়ু খুব নাজুক থাকে ফলে অল্প আঘাতেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। যার ফলে পরবর্তীতে জরায়ু ক্যান্সার, জরায়ুতে ঘা কিংবা বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি থাকে।

Dr. Kiyoshi Macotela Nakagaki :  জরায়ুর অবস্থান পেটে নয়, বরং পেলভিক ক্যাভিটিতে, যেটি পেটের নিচে অবস্থিত। একজন গর্ভবতী নারীকে আহত করতে হলে তাকে এমনভাবে আঘাত করতে হবে যেন তা হাড় ভাঙার সক্ষমতা রাখে। এমনকি জরায়ুতে খুব শক্ত আঘাতও বন্ধ্যাত্বের কারণ হয় না, যদি না সেই আঘাত থেকে ভারী রক্তপাতের কারণে জরায়ু অপসারণের প্রয়োজন পড়ে।

Dr. Anaïs Reyes Navarro : জরায়ুকে ঘিরে থাকে অন্ত্র, চর্বি, পেশি এবং চামড়া। সুতরাং গভীর ছুরিকাঘাত হলেই জরায়ুতে জখম সম্ভব।

এই ৪ টি কাজ বাদেও কোথাও কোথাও পঞ্চম আরেকটি বর্জনীয় কাজের কথা পাওয়া যাচ্ছে।

দাবি ৫। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে ঠান্ডা জল পান করার ফলে পিরিয়ডের রক্ত বের না হয়ে জরায়ু প্রাচীরে জমাট বাঁধতে পারে। যা পরবর্তী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে জরায়ু টিউমার বা ক্যান্সারের আকার ধারণ করতে পারে।

Dr. Kiyoshi Macotela Nakagaki :  এই দাবির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। জরায়ু প্রাচীরে ক্ষত সৃষ্টি অথবা না সৃষ্টির ব্যাপারে একজন নারীর কিছু করার নেই। এই লেখাটি ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে।

Dr. Anaïs Reyes Navarro : এই দাবি মিথ্যা। প্রতি মাসে জরায়ুর ভেতর এন্ডোমেট্রিয়াম নামে এক ধরনের টিস্যু তৈরি হয়। গর্ভধারণ না হলে এটি পিরিয়ডের সময় বের হয়ে যায়। অনেকে ধারণা করেন পিরিয়ড না হলে জরায়ুর ভেতরে রজঃস্রাবের রক্ত থেকে যায়। আসলে এন্ডোমেট্রিয়াম তৈরিজনিত সমস্যার কারণেই রজঃস্রাবের ঘাটতি দেখা দেয়।

উভয় ডাক্তারের মতে, শুধুমাত্র জরায়ু ক্যান্সার বলে কিছু নেই। জরায়ু সংক্রান্ত দুই ধরনের ক্যান্সার হতে পারে – এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার এবং সার্ভিকাল ক্যান্সার। Dr. Kiyoshi Macotela Nakagaki বলেন, এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের রোগীর বেশিরভাগের বয়স ৪০ বছরের ওপরে এবং তারা ইতোমধ্যে মেনোপজে পা দিয়েছেন। American Cancer Society-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের কারণ অজানা হলেও রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে আছে স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং হরমোন লেভেলের তারতম্য ঘটায় এমন বিষয়গুলো। Pan American Health Organization-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV) সার্ভিকাল ক্যান্সারের মূল কারণ।

 

আফ্রিকাভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং সাইট AfricaCheck ২০১৯ সালের ১৬ মে এই গুজবটি নিয়ে একটি রিপোর্ট করে। সেখানে দাবিগুলো সম্পর্কে নাইজেরিয়ার দুজন কনসাল্টেন্ট ডাক্তারের মতামত নেওয়া হয়। তারা বলেন, এর প্রতিটা দাবি মিথ্যা এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। রিপোর্টটি এই পোস্টকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে।

এ গুজবকে মিথ্যা দাবি করে Archyworldys সাইটের ২০২১ সালের ৩ জুন করা রিপোর্টটি দেখুন এখানে। সেখানেও এই পোস্টকে ভিত্তিহীন হবার কারণে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হয়।


ফ্যাক্টওয়াচের
সিদ্ধান্ত

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে, পিরিয়ডের সময় শ্যাম্পু ব্যবহার করার সাথে মাথাব্যথা, শরীরে শক্ত কিছুর আঘাত লাগার সাথে বন্ধ্যাত্বের, ঠান্ডা পানি, কোমল পানীয়, নারকেল এবং শশা খাওয়ার সাথে বন্ধ্যাত্ব ও ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে – এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এই গুজবটি পূর্বে কয়েকটি ভাষায় সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেও সম্প্রতি বাংলা ভাষায় ভাইরাল হয়েছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply