পেট্রোল বা জ্বালানি ছাড়াই গাড়ি চালানোর এই আইডিয়াটি বাস্তবে সম্ভব নয়

Published on: November 17, 2021

‘Problem solved, no more need of petrol’ অর্থাৎ, ‘সমস্যা শেষ, আর কোনো পেট্রোল লাগব না’-এমন শিরোনামযুক্ত একটি ছবি দীর্ঘদিন ধরেই ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে। এই ছবিতে বিশেষ উপায়ে দুইটা চুম্বক এর সাহায্যে একটি গাড়িকে চালানোর ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, এইভাবে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং, ‘প্রবলেম সলভড’ বলা ঠিক নয়। এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এ ধরনের আইডিয়াকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

গুজবের উৎস

বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পেজ এবং গ্রুপে এই ছবিটা দেখা যাচ্ছে। ফ্যক্টওয়াচ টিম এই ছবির মূল উৎস খুজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে । তবে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া কয়েটি পোস্ট দেখতে পাবেন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে  , এখানে , এখানে , এখানে


ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

যন্ত্র প্রকৌশলী এবং ফ্যাক্টচেকার জহিরুল ইসলাম জানান, প্রকৃতপক্ষে এখানে যে মেশিনটা দেখা যাচ্ছে, এটা শতাব্দী-প্রাচীন একটা ধাঁধা। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শতাব্দীতেই অনেক বিজ্ঞানী বা গবেষক এ ধরনের মেশিন তৈরি  করে জ্বালানি ছাড়াই গাড়ি চালাতে (বা শক্তি উৎপাদন করতে) চেয়েছেন। এধরনের মেশিনকে বলে Perpetual Motion Machine । অনেকে Free Energy Machine ও বলেন একে।

এ ধরনের মেশিনের ডিজাইন দেখে যে কেউ ভাবতে পারে, এই পদ্ধতিতে অবশ্যই পেট্রোল বা কোনো জ্বালানি/শক্তি ছাড়াই মেশিনটা চলবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মেশিনটা চালাতে গেলে দেখা যায়, ঘর্ষণ, মাধ্যাকর্ষণ, পৃষ্ঠটান কিংবা অন্য কোনো কারণে শক্তি ক্ষয় হয়ে মেশিনটা একটু পরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

উপরের এই বিখ্যাত মেশিনটি বানিয়েছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫ খৃষ্টাব্দ)। তার নাম অনুসারে একে ভাস্করের চক্র (Bhaskara Wheel) বলা হয়। তার প্রস্তাব ছিল, সাইকেলের চাকার আকৃতির এই চাকাটার বিভিন্ন বাহুর মধ্যে বিভিন্ন পাত্রে পানি/তরল পদার্থ রাখা হবে। ডানদিকে পানির ভর বেশি হলে মাধ্যকার্ষণ শক্তির প্রভাবে ওই চাকাটি নিচে ঝুকে পড়বে । ফলে ক্লকওয়াইজ চাকাটির ঘূর্ণন শুরু হবে । পরবর্তী প্রতিটা বাহুতেই একই পরিমান তরল পদার্থ থাকবে, ফলে সবসময়েই একটা দিক বেশি ভারি হবে। ফলে চাকাটি ঘুরতেই থাকবে।

তবে কার্যক্ষেত্রে গিয়ে দেখা গেল, এমন ধরনের চাকা কিছুক্ষণ পেণ্ডুলামের মত বামে ডানে ঘুরে স্থির হয়ে যাচ্ছে। কারণ, এক্ষেত্রে চাকাটির সেন্টার অফ গ্রাভিটি বারবার পরিবর্তন হচ্ছে।

ফরাসী বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল (১৬২৭-১৬৯১ খৃষ্টাব্দ) আরেকটি পারপেচুয়াল মোশন মেশিন ডিজাইন করেছিলেন। পানির কৈশিকতা (Capillary Action) নামে একটা ধর্ম আছে। এই ধর্মের প্রভাবে , সরু পাইপের মধ্য দিয়ে পানি/তরল পদার্থ উপরে উঠতে থাকে। এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রবার্ট বয়েল উপরের মেশিন ডিজাইন করেছিলেন। তার আশা ছিল, কাপের তলদেশ থেকে একটি সরু পাইপ যুক্ত করে দিলে অবিরতভাবে কাপ থেকে পানি উত্তোলন হতেই থাকবে। কখনো বন্ধ হবেনা।

তবে কার্যক্ষেত্রে গিয়ে দেখা গেল, গ্লাস এবং পানির কণার মধ্যকার আকর্ষণ বল পানির কৈশিক শক্তিকে কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে পানির কণাগুলো পাইপের শীর্ষ পর্যন্ত পৌছুতে পারছে না।

১৬৭০ সালে ইংল্যান্ডে রয়েল সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জন উইলকিন্স উপরের এই র‍্যাম্প ডিজাইন করেন। এটি Jon Wikinse Ramp নামে পরিচিত।  তার দাবি ছিল- একটি বড় টাওয়ারের উপরে একটি শক্তিশালী চুম্বক রাখা হলে , এবং একটি ছোট ধাতব বলকে এই র‍্যাম্পে রাখা হলে সেটি বারবার উপর নিচ করতে পারবে। কারন, চুম্বকের আকর্ষণে সে নিচ থেকে উপরে ( F থেকে B বিন্দুতে) পৌছাবে, তারপর ছিদ্র দিয়ে নিচেয় পড়ে যাবে, মাধ্যকার্ষণ শক্তির কারণে। এভাবে F বিন্দুতে এসে আবার উপরে ওঠা শুরু করবে।

তবে কার্যক্ষেত্রে এসে দেখা গেল, B বিন্দুতে পৌছার পরে বলটি আর নিচে না পড়ে উপরের চুম্বকের সাথে লেগে থাকছে।

আমাদের আলোচ্য গাড়ির ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটবে।

ডিজাইনার এখানে দাবি করছেন, ডানপাশের চুম্বকের আকর্ষণে বাম পাশের চুম্বক এগুবে। তার সাথে সাথে পুরো গাড়িটাও এগুবে। কিন্তু গাড়িটা এগোলে ক্রেনের সাহায্যে সংযুক্ত থাকা ডান পাশের চুম্বকটাও এগোবে। এভাবে অনন্তকাল গাড়িটা চলতে থাকবে—এমনটাই ছিল আইডিয়া।

তবে প্রাকটিকালি এমন ডিজাইনের গাড়ি বানানো হলে, ডান এবং বাম পাশের চুম্বক দু’টি একে অপরের সাথে লেগে যাবে। এবং গাড়িটি আর এগুবে না।

এছাড়া, এমন ধরনের গাড়ি বানানো হলে , সেটি চলার জন্য তাপগতিবিদ্যার সূত্র লঙ্ঘন করবে। কাজেই এমন মেশিন অসম্ভব।

No Need of Petrol Anymore Problem Solved | Meme on esmemes.com

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে অনেকেই চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন ডিজাইনের পারপেচুয়াল মোশন মেশিন বানানোর জন্য। তবে এদের কোনোটাই কাজ করেনা।

এ ধরনের মেশিনের এত বেশি আইডিয়া পাওয়া যায় যে আমেরিকার  United States Patent and Trademark Office (USPTO) ঘোষণা করেছে যে তারা কোনো পারপেচুয়াল মোশন মেশিনের ডিজাইন এর পেটেন্টের আবেদন গ্রহণ করবে না।

দৈনিক প্রথম আলো তাদের ‘যেমন চাই একটি বিজ্ঞান প্রকল্প’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে,  ‘অবিরাম গতিযন্ত্র’ অসম্ভব । অবিরাম গতিযন্ত্রের ইংরেজি হলো পারপেচুয়াল মোশন মেশিন, এটি এমন যন্ত্র যা কোনো শক্তি ছাড়াই আজীবন চলতে পারে। এমন কোনো যন্ত্র নেই, বানানোও সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের একেবারে গোড়ায় যে ব্যাপারগুলো আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে কাজ করতে শক্তি লাগবেই। গাধার সামনে মুলা ঝুলিয়ে দিলে মুলার টানে গাধা সামনে যাবে, কিন্তু সামনে যাওয়ার জন্য তাকে অবশ্যই শক্তি খরচ করতে হবে। তুমি কখনোই এমন কোনো যন্ত্র বানাতে পারবে না যা চালাতে বাইরে থেকে কোনো শক্তি দেওয়া লাগে না বা একবার দিলে সারা জীবন চলতে থাকে। একবার দেখে নাও তোমার যন্ত্রে কোথাও শক্তি খরচ না করে কাজ করার কথা তুমি ভাবছ কি না।

বাংলাদেশে পারপেচুয়াল মোশন মেশিন বানানোর প্রচেষ্টা

২০১৬ সালে বিজ্ঞানযাত্রা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই নিবন্ধে জহিরুল ইসলাম সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশের মধ্যে দাবি করা ১০ টা পারপেচুয়াল মোশন মেশিন এর ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করেন। শরিফুয়েললেস কিংবা হেকমত টেকনোলজি একটা সময়ে খুব আলোচনার জন্ম দিয়েছিল দেশব্যাপী।  এদের একটাও সম্ভব নয় বলে নিবন্ধে মতামত জানানো হয়েছিল।

৫ বছর পরেও এসব ডিজাইনের কোনোটিরই সাফল্যের কথা শোনা যাচ্ছে না।

তবে উক্ত ডিজাইনার/বিজ্ঞানীরা সবাই সরকারী/বেসরকারী আর্থিক সাহায্যের আবেদন করেছিলেন তাদের মেশিনের সফল বাস্তবায়নের জন্য।

তবে সাম্প্রতিক সময়েও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জ্বালানিবিহীন বিদ্যুৎ কিংবা ফ্রি এনার্জির দাবি পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী সেখান থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।


ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

আলোচ্য ডিজাইনটি একটি পারপেচুয়াল মোশন মেশিন ছাড়া কিছুই নয়। বাস্তবে এমন মেশিন কার্যকর নয়। অতীতেও কখনো কার্যকর হয়নি, বর্তমানেও সম্ভব নয়। এই ছবিটা অনেকে ট্রল হিসেবে শেয়ার করছে, আবার অনেকে একে বাস্তবেও কার্যকরী ভাবছে। কিন্তু সব মিলিয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই ছবিটা নিয়ে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে । তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই ছবিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

কৃতজ্ঞতা-

বিজ্ঞানযাত্রা
প্রথম আলো
রোর বাংলা
TED ED
Electro Boom
PBS space time

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply