১লা সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট বন্ধের ভুয়া দাবি

জহিরুল ইসলাম

Published on: August 31, 2024

যা দাবি করা হচ্ছে : ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন এর বরাতে দাবি করা হচ্ছে যে  আগামী ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে বাংলাদেশে সকল পর্নোগ্রাফিক সাইট বন্ধ থাকবে। ধর্ম উপদেষ্টার নামে খোলা একাধিক ফেসবুক আইডি থেকেও এই দাবি করা হচ্ছে।

যা পাওয়া যাচ্ছে : ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইন এর আসল ফেসবুক আইডি থেকে এমন কোনো তথ্য জানানো হয়নি। বরং ধর্ম উপদেষ্টার সহকারী জানিয়েছেন, তাঁর নামে খোলা ভুয়া একাউন্ট থেকে পর্নোগ্রাফিক সাইট বন্ধের এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

গুজবের উৎস

ছড়িয়ে পড়া কয়েকটা পোস্ট দেখতে পাবেন এখানেএখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে ।

ড আ ফ ম খালিদ হোসেন নামযুক্ত কয়েকটি আইডি থেকেও এমন পোস্ট করা হয়েছে। যেমন দেখুন এখানে,এখানে,এখানে

এসব পোস্টে বলা হয়েছে, আগামী ১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে বাংলাদেশে সকল পর্নোগ্রাফি সাইট বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশ হাইকোর্টের নির্দেশনায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, পরবর্তী ছয় মাসের জন্য সকল পর্নোগ্রাফি সাইট ব্লক থাকবে। মূলত যুবসমাজের নৈতিক ও মানসিক বিকাশ সুরক্ষার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি) ইতিমধ্যেই এই নির্দেশনা কার্যকর করতে শুরু করেছে।

অনুসন্ধান

ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালিদ হোসেন এর নামযুক্ত একাউন্ট এবং পেজগুলো অনুসন্ধান করা যাক।

বাংলায় ‘ড. আ.ফ.ম খালিদ হোছাইন’ নামের এই একাউন্টে ৬৩,০০০ ফলোয়ার রয়েছে। ৮ই আগস্ট ২০২৪ তারিখ থেকে এই একাউন্টের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। এর পূর্বের কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছেনা।

‘ড. আ ফ ম খালিদ হাসান’ নামক ২৭৩ ফলোয়ারযুক্ত পেজটিও কার্যক্রম শুরু করে ৮ই আগস্ট থেকে। অপরদিকে আল্লামা ড: আ ফ ম খালেদ হোসেন নামক ১৬০ জন ফলোয়ারযুক্ত পেজটি গত ২৩শে আগস্ট থেকে কার্যক্রম শুরু করেছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ এর ওয়েবসাইটে ধর্ম উপদেষ্টার নামের বানান- ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসেন-এই রুপে দেখা যাচ্ছে। যে বানানটি উক্ত ২ টি পেজ এবং একটি একাউন্ট-কোনোটির নামের সাথেই মেলেনা।

ইংরেজিতে Afm Khalid Hossain নামক ১৬৯ হাজার ফলোয়ারযুক্ত একটি একাউন্ট, এবং Professor Dr. A.F.M. Khalid Hossain নামক ৪০ হাজার ফলোয়ারযুক্ত একটি পেজকে ২০০৯ সাল থেকেই অনলাইনে সচল দেখা যাচ্ছে। এই আনভেরিফাইড একাউন্ট এবং পেজ দুটিই ধর্ম উপদেষ্টার আসল একাউন্ট এবং পেজ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ধর্ম উপদেষ্টার এই আসল একাউন্ট এবং পেজ থেকে পর্নোগ্রাফিক সাইট বন্ধ সংক্রান্ত কোনো খবর দেখা যাচ্ছেনা। এছাড়া, কোনো গণমাধ্যমেও সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।

অধিকতর অনুসন্ধান দেখা যাচ্ছে, অতীতে কয়েকবার বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। দৈনিক যুগান্তরে ২০১৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশে পর্নো ওয়েবসাইট বন্ধের যত উদ্যোগ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১০ সালের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে ৮৪টি পর্নো ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় পুলিশ সদর দফতর। চিঠিতে ওই ওয়েবসাইটগুলোকে অশ্লীল ও বিকৃত উল্লেখ করে বিটিআরসির মাধ্যমে সেগুলো বন্ধ করে দেয়ার আবেদন জানানো হয়। জানা যায়, বিটিআরসি উদ্যোগ নিলে দুই সপ্তাহের মতো বন্ধ ছিল পর্নো সাইটগুলো। পরে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আবারও সক্রিয় হতে থাকে পর্নো সাইটগুলো। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার দেশে ৫৬০টি পর্নো সাইট বন্ধের নির্দেশ দেয়। সেসময় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক জানান, বিটিআরসির পাঠানো ৫৬০টির মধ্যে ৯০ শতাংশ সাইট বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। সেই বছরই এক অভিভাবকের অসহায়ত্বের চিঠির সূত্র ধরেই পর্নো সাইটগুলো বন্ধের উদ্যোগে গতি আসে। কিন্তু ২০১৭ সালে এসেই এ উদ্যোগে ভাটা পড়ে। এরপর ২০১৮ সালে মোস্তাফা জব্বার এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার শেষ সময়ে এসে আবারও পর্নো সাইট বন্ধের উদ্যোগ নেন। সবশেষ দ্বিতীয় দফা মন্ত্রী হওয়ার পর চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে এসে তিনি পর্নো সাইটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

২০১৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখা একটি স্ট্যাটাসে জানিয়েছিলেন, ‘২৪৪‌টি পর্ন সাইট বন্ধ ক‌রে‌ছি। অভিযান চলছে, চলবে’।

একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আইইবির কম্পিউটার কৌশল বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মোস্তফা জব্বার দাবি করেন “ইতোমধ্যেই ২০ হাজার পর্নো সাইট বন্ধ করা হয়েছে।”

তবে এসকল ওয়েবসাইটের নাম-ঠিকানা জনসমক্ষে প্রকাশ না করায় ‘ওয়েবসাইট বন্ধ করা’র এই দাবিগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। একইসাথে , রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে এসকল ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ থেকে সহজে দেখা বা এ্যাক্সেস করার বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না , সেটাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়া, অতীতের খবরগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, তাৎক্ষনিকভাবে ওয়েবসাইট বন্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছিল, অথবা আগে বন্ধ করে তারপরে গণমাধ্যমে খবরটা জানানো হয়েছিল। নির্দিষ্ট দিন তারিখ উল্লেখ করে কোনো ওয়েবসাইট বন্ধের কথা অতীতে জানানো হয়নি।

সাম্প্রতিককালে ধর্ম উপদেষ্টার বরাতে পর্নোগ্রাফিক সাইট নতুন করে বন্ধ করার গুজব ভাইরাল হওয়ার পরে ধর্ম উপদেষ্টার একান্ত সহকারী ইকরামুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, বিষয়টি ভুয়া। একটি শ্রেণী ধর্ম উপদেষ্টার সুনাম ক্ষুণ করার চেষ্টা করছে। উপদেষ্টার বক্তব্যের জন্য তার ব্যক্তিগত আইডি ও ফেসবুক পেইজ ফলো করা উচিত।

ফেক আইডির বিড়ম্বনা এড়াতে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ দেখুন এখানে,এখানে,এখানে, এখানে

সিদ্ধান্ত

সার্বিক বিবেচনায়, ১ লা সেপ্টেম্বর থেকে পর্নোগ্রাফিক সাইট বন্ধ সংক্রান্ত ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh