ভারতে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যাকে ঘিরে বিয়ে এবং ধর্ম পরিবর্তনের ভুয়া দাবি

Published on: March 7, 2023

সম্প্রতি ভারতের তেলেঙ্গানায়  এক মেডিকেল শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে একটি ভূয়া দাবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, সাইফ নামে একই প্রতিষ্ঠানের অন্য এক শিক্ষার্থীকে বিয়ে করে নিজ ধর্ম পরিবর্তন করেন প্রীতি। কিছুদিন পর মানসিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেন প্রীতি। কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে, সাইফ নামে সেই শিক্ষার্থীকে বিয়ে করে ধর্ম পরিবর্তনের কোনো সত্যতা পাওয়া যায় নি। তবে, ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, প্রীতির আত্মহত্যার পিছনে সাইফের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে এবং তার প্রেক্ষিতে তাকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে তবে মূলধারার গণমাধ্যম থেকে প্রীতির বিয়ে কিংবা ধর্ম পরিবর্তনের কোনো তথ্য খূঁজে পাওয়া যায় নি। এছাড়া এই দাবিটিকে অপতথ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ‘মাথ্রুভূমি (Mathrubhumi)’ নামক  ভারতের কেরেলার গণমাধ্যমের ফ্যাক্টচেকার শচীন কুমার।

 

এমন কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

এসব পোস্টে বলা হচ্ছে, “তেলেঙ্গানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আত্মীয় ডঃ মহঃ সাইফকে বি‌য়ে ক‌রে‌ছি‌ল ২৬ বছর বয়সী ডঃ ধর্মাবতী প্রীতি।

হিসাব মতন বিয়ের পর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম কবুল করেছিল ধর্মাবতী।

কিছুদিন ধর্মাবতীর দেহ ভো‌গের পর ভিন্ন নারী‌তে আসক্ত হয় মহঃ সাইফ!

প্রী‌তির উপর শুরু ক‌রে মানসিক নির্যাতন!

দি‌নের পর দিন অত‌্যাচা‌র সহ্য করতে করতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় প্রীতি; এখন হাসপাতা‌লে মৃত্যুশয্যায় দিন কাট‌ছে প্রী‌তির।

😥

দুঃখের খবর এটাই কোনো ফ্রীজ বা সুইটকেশ প্রীতির কপালে জুটলো না!  #কর্মফল  👇

 

অর্থ্যাৎ, প্রীতির আত্মহত্যার পিছনে মূল কারণ হিসেবে বিয়ে করে ধর্ম পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান 

ভাইরাল এসব পোস্টে একটি ছবি দেখতে পাওয়া যায়। উক্ত ছবির সাহায্যে অনুসন্ধান করা হলে, লেটেস্টলি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ প্রকাশিত এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ছবিতে থাকা মেয়েটির নাম ডাঃ ধারাবাথ প্রীতি (Dharavath Preethi)। তিনি ভারতের তেলেঙ্গানার কাকাতিয়া মেডিকেল কলেজের স্নাতকোত্তর ১ম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী এবং কিছুদিন আগে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এই ঘটনায় একই প্রতিষ্ঠানের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ডাঃ এম. এ. সাইফের নামে প্রীতিকে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এর প্রেক্ষিতে তাকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয়।

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রীতি মারা গিয়েছেন। একই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রীতির মৃত্যুর পিছনে তার কলেজের সিনিয়রদের দায়ী করেন প্রীতির বাবা।

 

২ মার্চ ২০২৩ এ প্রকাশিত দ্য হিন্দু’র একটি প্রতিবেদন থেকে ডাঃ সাইফের রিমান্ড রিপোর্টের বিস্তারিত পাওয়া যায়। জানা যায়, সাইফ প্রীতিকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অপমান করে এবং এর প্রেক্ষিতে প্রীতি অভিযোগ করলে হয়রানির মাত্রা বাড়তে থাকে। ডাঃ সাইফের মোবাইল থেকে ১৭ টি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট এবং একটি গ্রুপচ্যাট পর্যবেক্ষণ করে সেই রিপোর্টে বলা হয়, প্রীতির সামাজিক অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন মানহানিকর মন্তব্য এবং ইমোজির প্রমাণ পাওয়া পুলিশ। উক্ত রিপোর্ট নিয়ে এই প্রতিবেদনে আরোও বলা হয়, “প্রীতিকে 18 ফেব্রুয়ারি একটি প্রি-অ্যানেস্থেসিয়া চেক-আপ (PAC) রিপোর্ট ফাইল করতে বলা হয়েছিল তার সিনিয়র ডাঃ সাইফ এই রিপোর্টটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রচার করেছিলেন এবং তাকে অপমান করেছিলেন। এরপর প্রীতি তাকে এমন আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করে একটি ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, যদি তার কাজ সম্পর্কে কোনও সমস্যা হয় তবে তিনি এইচওডির (হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট) কাছে অভিযোগ করতে পারেন। সাইফ এর এমন আচরণ অব্যাহত থাকলে, প্রীতি বিষয়টি এইচওডি নাগার্জুনকে জানায় আত্মহত্যার চেষ্টা করার একদিন আগে, ডাক্তার মুরালি, শ্রীকলা এবং প্রিয়দর্শিনির উপস্থিতিতে, ডাঃ সাইফ প্রীতিকে তার সাথে ডিউটতে না যেতে বলেন। পুলিশ আরও বলেছে যে ডাঃ সাইফ প্রীতির অভিযোগকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন এবং তার বন্ধুদেরকে তাকে বিশ্রাম না দিয়ে RICU তে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিতে বলেছেন”।

 

অর্থ্যাৎ, প্রীতির সাথে সাইফের ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্কের প্রমাণ রিমান্ড রিপোর্ট কিংবা মূলধারার গণমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় নি। সব জায়গায় ডাঃ সাইফকে ডাঃ প্রীতির “সিনিয়র” কিংবা প্রীতিকে সাইফের “জুনিয়র” বলেই সম্বোধন করা হয়। নিচে ভারতের মূলধারার কিছু গণমাধ্যম প্রকাশিত প্রতিবেদনের কয়েকটি স্ক্রিনশট উপস্থাপন করা হলোঃ




 

এছাড়া ভারতের কেরেলার “মাথ্রুভূমি (Mathrubhumi)” নামে একটি সংবাদমাধ্যমের ফ্যাক্টচেকার শচীন কুমারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিয়ে কিংবা ধর্ম পরিবর্তনের দাবির সত্যতা আছে কি না সেটি যাচাই করেন। তার অনুসন্ধানে তিনি এটিকে ডিসইনফরমেশন বা অপতথ্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। আরোও বলেন যে, উক্ত মামলায় এমন কোনো দাবির উল্লেখ নেই।

 

অতএব নিশ্চিতভাবেই বুঝা যাচ্ছে ডাঃ প্রীতির সাথে ডাঃ সাইফের বিয়ে এবং পরবর্তীতে ধর্ম পরিবর্তনের দাবিটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পুলিশের দেয়া রিমান্ড রিপোর্ট কিংবা মূলধারার গণমাধ্যমে প্রীতি এবং সাইফের মধ্যকার সম্পর্ক হিসেবে শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজের সিনিয়র/জুনিয়র পরিচয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ফ্যাক্টওয়াচের বিবেচনায় উক্ত দাবিকে “মিথ্যা” সাব্যস্ত করা হচ্ছে।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh