কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনে কতজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন?

Published on: November 26, 2022 

ফ্যাক্ট-ফাইল

 

শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যাগুলো সঠিক, কিন্তু এদের সবাই বিশ্বকাপের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারান নি। ডয়চে ভেলের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদনবলছে, এসব অভিবাসীরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, সবাই নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন না। এ বিষয়ে একটি ফ্যাক্টফাইল তৈরি করেছেন মোহাম্মদ আরাফাত।

প্রস্তাবনা

সম্প্রতি কাতার বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেখানে দাবি করা হচ্ছে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহ: ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, এবং শ্রীলঙ্কা এর যথাক্রমে ২৭১১, ১৬৪১, ১০১৮, ৮২৪, এবং ৫৫৭ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। উক্ত পোস্টটির দুটো নমুনা দেখুন এখ এবং এখে।

শ্রমিক মৃত্যুর এই সংখ্যাগুলো উদ্ভূত হয়েছে ‘দি গার্ডিয়ান’ এর একটি রিপোর্ট থেকে। উক্ত পোস্টের দাবির সত্যতা যাচাই করতে আমরা ‘দি গার্ডিয়ান’ এর রিপোর্টটি পড়ে দেখেছি এবং জানতে পেরেছি যে শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যাগুলো সঠিক কিন্তু রিপোর্টে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে এসকল শ্রমিকরা সবাই কাতার বিশ্বকাপের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যম ‘দি গার্ডিয়ান’ এর রিপোর্টটি স্রেফ বাংলায় অনুবাদ করে “কাতার বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশি ১০১৮ শ্রমিকের মৃত্যু,” “কাতারে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি: বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৬৫০০ শ্রমিকের মৃত্যু” ইত্যাদি শিরোনামে প্রকাশ করেছে। তাছাড়া, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ এর রিপোর্ট থেকে উদ্ভূত কাতার বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে ১৫ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে এবং এর অনুসন্ধান করতে গিয়ে উক্ত রিপোর্টটি পড়ে আমরা জানতে পেরেছি যে মৃত ১৫ হাজার শ্রমিকের সবাই বিশ্বকাপ প্রস্তুতির কাজে জড়িত ছিলেন না এবং প্রত্যেকেই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ফ্যাক্টওয়াচ উক্ত ফেসবুক পোস্ট এবং বাংলাদেশের কিছু সংবাদ মাধ্যমে কাতার বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে শ্রমিকের মৃত্যু মর্মে প্রকাশ হওয়া সংবাদের শিরোনামগুলোকে বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করছে।

 

দি গার্ডিয়ানএর রিপোর্ট কি বলছে?

গত ২৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ এ ব্রিটেন-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘দি গার্ডিয়ান’ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে “Revealed: 6,500 migrant workers have died in Qatar since World Cup awarded” শিরোনামে, যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়: “বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়ার পরে কাতারে ৬৫০০ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।” রিপোর্টটি থেকে জানা যায় ২০১১-২০২০ সময়কালে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, এবং শ্রীলঙ্কার ৫৯২৭ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয় এবং ২০১০-২০২০ সময়কালে ৮২৪ জন পাকিস্তানি অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয় কাতারে। অর্থাৎ, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়ার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১২ জন দক্ষিণ এশিয়ার এই পাঁচটি দেশের অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে কাতারে। রিপোর্টটির কোথাও উল্লেখ নেই এই সকল মৃত শ্রমিকরা কোন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন বা তারা কোথায় কাজ করতেন। তবে উপসাগরীয় অঞ্চলে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপের পরিচালক নিক ম্যাকগিহান মনে করেন যেহেতু শ্রমিকদের মৃত্যু রেকর্ড তাদের পেশা এবং কাজের জায়গা অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস করা নেই, সম্ভবত তাদের অনেকেই বিশ্বকাপের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।

কাতারে শ্রমিকদের এই মৃত্যুর হারের পিছনে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে উঁচু জায়গা থেকে ভূমিতে পড়ে মারাত্মক জখম হওয়া, অনেক উচ্চতায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে গিয়ে শ্বাসরোধ হওয়া, জখম হওয়া জায়গায় পচন ধরা। গার্ডিয়ান তাদের প্রাপ্ত ডাটার উপর ভিত্তি করে জানিয়েছে যে ভারতীয়, নেপালি, এবং বাংলাদেশী শ্রমিকদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ মৃত্যু ‘প্রাকৃতিক মৃত্যু’ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হয়েছে। প্রাকৃতিক মৃত্যু বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে হৃদযন্ত্র বা শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়া। তবে ি অন আরকটি ি মতে শ্রমিকদের মৃত্যুর এই শ্রেণীবিন্যাস করা হয় সাধারণত ময়নাতদন্ত ছাড়াই এবং প্রায়শই শ্রমিকদের মৃত্যুর অন্তর্নিহিত কারণ ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালে আনতরি রম একটি তথ্য অনুসারে জানা গিয়েছে, কাতারের গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ শ্রমিকদের মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে।

অতএব, ‘দি গার্ডিয়ান’ এর রিপোর্টটি পড়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানে শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে শুধুমাত্র বিশ্বকাপের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের সাথে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়নি এবং রিপোর্টটিতে মৃত শ্রমিকরা কোন পেশায় এবং কোথায় নিয়োজিত ছিলেন সেই ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালএর রিপোর্ট কি বলছে?

গত ২৬ই আগস্ট, ২০২১ এ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল “In the prime of their lives: Qatars failure to investigate, remedy and prevent migrant workersdeaths” শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়েছে গত ১০ বছরে কাতারে ১৫,০২১ জন বিভিন্ন পেশার এবং বয়সের অ-কাতারি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ১৫,০২১ জন মৃত মানুষদের সবাই নির্মাণ শ্রমিক নয় বরং তাদের মধ্যে রয়েছেন নিরাপত্তাকর্মী, মালী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এবং ব্যবসায়ী। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই রিপোর্টটিতে ১৫,০২১ সংখ্যাটি নির্দেশ করা হয়েছে ২০১০-২০১৯ সময়কালে কাতারে যতজন বিদেশীর মৃত্যুর হয়েছে তার প্রতি এবং ২০১১-২০২০ সময়কালে সংখ্যাটি ছিলো ১৫,৭৯৯।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্টটিতে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরোগকে (cardiovascular disease) শ্রেণীভুক্ত করা হলেও উপযুক্ত তদন্তের অভাবে শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণের তথ্য অনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়েছে এবং ব্যাখ্যাতীত রয়ে গিয়েছে।

অতএব, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্টটি পড়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানে যে ১৫,০২১ সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে তা কেবল কাতারে মৃত্যু হয়েছে এমন অভিবাসী শ্রমিকদের নয় বরং কাতারে বিভিন্ন পেশা এবং বয়সের যে বিদেশীরা ছিলেন তারাও এই সংখ্যার অন্তর্ভুক্ত।

 

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো কি বলছে?

কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর নিজস্ব কোন বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ ‘কাতার বিশ্বকাপ শ্রমিক মৃত্যু’ বাক্যটি দিয়ে সার্চ করে আমরা বেশকিছু সংবাদের খোঁজ পাই যেগুলো কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ। তার মধ্য থেকে বেশ কয়েকটি সংবাদ আমরা পড়ে দেখি এবং জানতে পারি প্রায় সবগুলো সংবাদই ‘দি গার্ডিয়ান’ এর ইংরেজি রিপোর্টটিকে স্রেফ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে। উক্ত সংবাদগুলোর শিরোনামও বেশ বিভ্রান্তিকর ছিলো। আসুন, আমরা কাতার বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে শ্রমিকের মৃত্যু মর্মে প্রকাশ হওয়া কিছু সংবাদের শিরোনাম দেখি।

 

িবক রসিাংি ১০১৮ রমি ু – তর

 

িবক রসিে ১ াংি রমি ু – ি

 

িবক বলি’ াংি – িউজ াংা২৪.কম

 

িবক রসিাংি ১০১৮ রমি ু – ি ইত

 

িবক রসিে ১০ বছরাংী ১০১৮ রমি ু : দকি এশি ৬৭৫১ জনভয় অব আমিাং

 

িবক লজা: ৫৭৬০ িি টবলে ১৫ ু! – রথম আল

 

িবক আয়জন : দশ বছরে ১ ১৮ াংি রমি ু – রতিি

 

িবক রসিাং, রত, ি ে ৬ রমি ু – ি

 

িবক রসি সহসি াংি রমিইলি টস িি

 

উপরের সংবাদ শিরোনামগুলো দেখে বুঝা যাচ্ছে ‘দি গার্ডিয়ান’ এর রিপোর্টটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করলেও রিপোর্টটিতে যে কোথাও বিশ্বকাপ আয়োজনে শ্রমিকের মৃত্যুর কথা উল্লেখ নেই সেটা সংবাদমাধ্যমগুলো খেয়াল করেনি এবং বিভ্রান্তিকর কিছু শিরোনামে ব্যবহার করে সংবাদ প্রকাশ করে দিয়েছে। উক্ত শিরোনামগুলো পড়লে মনে হবে বিশ্বকাপ আয়োজনে বিভিন্ন নির্মাণ কাজ করতে গিয়েই এতসংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, যদিও শ্রমিকদের মৃত্যুর যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে কাতার। শিরোনামগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সেখানে বলা হচ্ছে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতিতে ১০১৮ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বা দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের সাড়ে ছয় হাজার শ্রমিক মারা গিয়েছে কিন্তু ‘দি গার্ডিয়ান’ এর রিপোর্টে এসকল শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে শুধু বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতিতে জড়িত থাকার কথা বলা হয়নি।

 

ডয়চে ভেলেএর ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট কি বলছে?

কাতার বিশ্বকাপে কতজন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছে এটা নিয়ে ডয়চে ভেলে ১৬ই নভেম্বর, ২০২২ এ একটি িং ি প্রকাশ করে। মূলত দি গার্ডিয়ান এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্ট থেকে উদ্ভূত কাতারে শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা কতটা সঠিক তা যাচাই করতে ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টটি তৈরি করে তারা। তাদের রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা দি গার্ডিয়ান কেউ-ই এই দাবি করেনি যে এই সকল শ্রমিকরা সবাই অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। উভয় রিপোর্টে উল্লেখিত শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা কাতারে গত এক দশকে মারা যাওয়া অ-কাতারি বিভিন্ন জাতীয়তা এবং পেশার মানুষদের নির্দেশ করে। ডয়চে ভেলের ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে ১৫ হাজার বিদেশীর মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ করেছে তাদের সবাই নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন না বরং তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। যেমন: নিরাপত্তাকর্মী, মালী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এবং ব্যবসায়ী।

সিদ্ধান্ত

যেহেতু দি গার্ডিয়ান এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্টের কোথাও বলা হয়নি মারা যাওয়া শ্রমিকরা সবাই বিশ্বকাপের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজে জড়িত ছিলেন, তাদের পেশা এবং তারা কোথায় কি কাজে নিয়োজিত ছিলেন সেটা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, এবং শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করতে কাতার ব্যর্থ হয়েছে তাই আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে কাতারে অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট এবং বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে করা সংবাদগুলোর শিরোনাম বিভ্রান্তিকর।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh