পুকুরপাড়ে পাওয়া সাপ ও সাপের বাচ্চাগুলো কি রাসেলস ভাইপার?

Published on: May 6, 2023

একটি পুকুরে ৩২টি বাচ্চাসহ বিষধর রাসেলস ভাইপার সাপের দেখা মিলেছে। এমন একটি সংবাদ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে সংবাদটির মাঝে একাধিক অসংগতি পাওয়া গেছে। মূল সাপটি রাসেলস ভাইপার হলেও ৩২টি সাপের বাচ্চা নির্বিষ জল ঢোঁড়া সাপের। এছাড়া প্রতিবেদনে রাসেলস ভাইপার সাপটিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমন দাবিটিও সঠিক নয়। রাসেলস ভাইপার থেকেও বিষধর দুটি সাপ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। একাধিক অসত্য তথ্য থাকায় এসব পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “আংশিক মিথ্যা” সাব্যস্ত করছে।

এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে,  এখানে, এবং এখানে

 

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান: 

৩২টি বাচ্চাসহ পুকুরের পাশে মিললো বিষধর রাসেলস ভাইপার এই শিরোনামে ঘটনাটি নিয়ে DHAKA POST একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটির ভিতরের অংশে বলা হয়েছে, “সাপগুলো রাসেলস ভাইপার প্রজাতির বলে জানিয়েছেন বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা তন্ময় আচার্য্য।” অর্থাৎ সাপের ৩২টি বাচ্চা এবং বড় সাপটি উভয় রাসেলস ভাইপার প্রজাতির এমন দাবি করা হচ্ছে প্রতিবেদনে। তবে একই প্রতিবেদনের নিচের অংশে বলা হয়েছে, “বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা শাকিলা নার্গিস বড় সাপটির ছবি দেখে তা রাসেলস ভাইপার বলে নিশ্চিত করেন। কিন্তু তিনি বলেন, সাপের বাচ্চাগুলো সেই রাসেলস ভাইপারের কিনা তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না”। 

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে একই প্রতিবেদনে দুজনের বরাতে দুরকম তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। যে কারণে ছবি ও ভিডিওতে দেখতে পাওয়া সাপগুলো আসলে কি একই প্রজাতির বা ভিন্ন প্রজাতির তা জানতে বন্যপ্রাণী গবেষক ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার আদনান আজাদের সাথে কথা বলা হয়। ফ্যাক্টওয়াচকে তিনি জানান, “বিভিন্ন প্রতিবেদনে এই নিউজটি তিনি দেখেছেন। এ ধরণের ভিত্তিহীন তথ্য প্রাণ-প্রকৃতির জন্য হুমকি স্বরূপ এ বিষয়টি সাংবাদিকদের মাথায় রাখতে হবে। ছবি ও ভিডিওতে দেখতে পাওয়া বড় সাপটি রাসেলস ভাইপার। সাপের বাচ্চাগুলো Checkered Keelback (non-venomous) ঢোঁড়া সাপ নির্বিষ। রাসেলস ভাইপার বাচ্চা প্রসব করে, তবে একসাথে একাধিক বাচ্চা প্রসব করে না। বরং বিরতি নিয়ে একএকটি করে বাচ্চা প্রসব করে। ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে মায়ের থেকে বাচ্চাটি দূরে চলে যায়। এইভাবে পর্যায়ক্রমে একাধিক বাচ্চা প্রসব হয় ও মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায়। যে কারণে একত্রে একসাথে একাধিক রাসেলস ভাইপের বাচ্চা সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না। তবে কোনো স্থান যদি চারপাশ থেকে ঘেরা থাকে তাহলে ওই বাচ্চাগুলো নিদিষ্ট সীমানার মধ্যে চলাফেরা করে। সেক্ষেত্রে একত্রে দেখতে পাওয়া সম্ভব। তবে জল ঢোঁড়া যেহেতু ডিম পাড়ে তা থেকে বাচ্চা ফুটে। সেক্ষেত্রে দেখা যায় প্রায় একই সময় সবগুলো বাচ্চা একসাথে ডিম ফুটে বাইরে বেরিয়ে আসে। যে কারণে অনেক বাচ্চাও একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। এখানের মূল ঘটনা হতে পারে রাসেলস ভাইপার সাপটি কোনোভাবে সেখানে এসেছে, এবং একই সময়ে ঢোঁড়া সাপের বাচ্চা ডিম ফুটে ওই একই এলাকায় বেরিয়ে এসেছে। 

একই প্রতিবেদনটির ব্যাপারে তথ্য দিতে কনজারভেশন একটিভিস্ট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া ফ্যাক্টওয়াচের সাথে যোগাযোগ করেন। উল্লেখ্য বাংলাদেশের প্রথম নারী স্নেক রেসকিউয়ার ছিলেন তিনি। ফ্যাক্টওয়াচকে তিনি জানান, এখানে একটি মাত্র সাপ রাসেলস ভাইপার। বাকি সাপগুলো নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের। কোনোভাবে পানিতে ভেসে রাসেলস ভাইপার সাপটি সেখানে চলে এসেছে। বাকি সাপগুলো ওই পুকুরের পাড়ে জন্মলাভ করেছে।

এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে বাংলাদেশ রিসার্চ ভেনমের গবেষণা সহকারী ও প্রাণী গবেষক রফিকুক ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনিও বলেন সাপের বাচ্চাগুলো কোনোভাবে রাসেলস ভাইপারের নয়। সেগুলো নির্বিষ ঢোঁড়া সাপের। ঢোঁড়া সাপের বাচ্চা ও একটি রাসেলস ভাইপার একস্থানে দেখতে পাওয়া গেছে বলে অসেচতন জনসাধারণ সবগুলো সাপকে রাসেলস ভাইপার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

এরই মধ্যে Deep Ecology and Snake Conservation Foundation নামের গভমেন্ট অথরাইজড বন্যপ্রাণী উদ্ধারকারী একটি প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমে প্রচারিত এ ধরণের সংবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদলিপি স্টিকার আকারে প্রকাশ করেছে। এখানে। এটিও আমাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে।

 

বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, সাপ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কিছু অমূলক ধারণা রয়েছে। বায়োডাইভারসিটি রক্ষার্থে সাপের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই প্রয়োজনীয় তথ্যটি সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছাতে পারেনি। সাপে কামড়ালে কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক চিকিৎসা গ্রহণের ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখনো সাপের কামড়ে মারা যান। তবে বাংলাদেশে বিষধর ও বিষাক্ত সাপের প্রজাতির সংখ্যা একেবারে নগণ্য। সাপের বিভিন্ন প্রজাতি নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচের পূর্বের একটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে। 

প্রতিবেদনগুলোতে রাসেলস ভাইপার সাপটিকে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বিষধর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথ্যটিও সত্য নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ হলো Yellow bellied sea snake যা রঙিলা সামুদ্রিক সাপ নামে পরিচিত ৷ এটা পৃথিবীর চতুর্থ সবচেয়ে বিষধর সাপ ৷ অতীব বিষধর সাপটি গোখরা, কেউটের মতো Elapidae পরিবারের৷ সাপটির বিষের SCLD50 মান 0.067 mg/kg. এত বিষধর হলেও এর মানুষকে ছোবলের রেকর্ড নেই ৷ কারণ এরা সামুদ্রিক, কোন কারণে ঢেউয়ে ভেসে তীরে এলেও আটকে যায় ৷ মাটিতে একদমই চলতে পারে না, মারা যায় ৷ বাংলাদেশে লোকালয়ে পাওয়া যায় এরূপ সবচেয়ে বিষধর স্থলচর সাপ হলো পদ্মগোখরা (monocled cobra) যা চন্দ্রবোড়া বা Russell’s viper এর চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি বিষধর। 

অতএব একাধিক ত্রুটিপূর্ণ ও মনগড়া তথ্য সন্নিবেশ করে প্রতিবেদন তৈরি করার কারণে এ ধরণের সংবাদগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “আংশিক মিথ্যা” সাব্যস্ত করেছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh