ঢাকার রাস্তায় ভয়ঙ্কর মাইন্ড-কন্ট্রোল ড্রাগ স্কোপোলামিন – ভূয়া খবর

Published on: January 29, 2022

সাবধান! কোনো রিক্সা বা CNG-ড্রাইভার কাগজে কিছু পড়তে দিলে পড়বেন না। পড়লে আপনি কাগজে থাকা পাউডারের সংস্পর্শে অজ্ঞান হয়ে সব হারাবেন – এমন একটি পোস্ট সম্প্রতি ফেসবুকে শেয়ার করা হচ্ছে। এটি একটি পুরনো ইন্টারনেট গুজব যা সম্প্রতি বাংলাদেশে ভাইরাল হয়েছে। 

গুজবের উৎস

Govt. circular নামক ফেসবুক পেজ থেকে গত ২০ জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ৩:১২ টায় এই পোস্ট করা হয় এবং শেয়ার হয় কমপক্ষে ৭৫ হাজার বার। এমন আরও কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে , এখানে , এখানে , এখানে

ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট এবং ভেরিফাইড অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে এ ধরনের কোনো প্রজ্ঞাপন খুঁজে পাওয়া যায় নি। Govt Circular নামে যে আনভেরিফাইড পেজ থেকে এটা শেয়ার করা হচ্ছে, সেটি কোনো সরকারি পেজ নয়।

গত বছর নভেম্বর মাসে ফেসবুকে স্কোপোলামিন নামক ড্রাগ দ্বারা পথঘাটে যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেওয়ার একটি পোস্ট ভাইরাল হয়। পোস্টটিতে বলা হয়, দেশে বিভিন্ন জায়গায় একটি চক্র হ্যান্ডশেক, কাগজ এবং মোবাইল ফোনে স্কোপোলামিন নামক একটি ড্রাগ মিশ্রিত করে এর সংস্পর্শে সাধারণ মানুষকে এনে হিপনোটাইজড করার মাধ্যমে তার সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। কালপ্রিট তার হাতের চামড়ায় স্কোপোলামিন মাখিয়ে নিয়ে ভিকটিমের সাথে বিভিন্ন ছুতায় হ্যান্ডশেক করে। ড্রাগটি ভিক্টিমের শরীরে ঢুকে কার্যকরী হয়ে ওঠে, ভিকটিমকে সম্মোহিত করে ফেলে। সম্মোহনের মাধ্যমে ভিকটিমের কাছ থেকে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়া হয়। হ্যান্ডশেকের সময় হাতে সিরিঞ্জ বা পিন ফুটিয়ে শরীরে স্কোপোলামিন প্রবেশের কথাও বলা হয়েছে। হ্যান্ডশেক বা স্পর্শ ছাড়াও, অনেক সময় একটি কাগজে বা মোবাইল ফোনে স্কোপোলামিন মাখিয়ে সেটি ভিকটিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়। নাক থেকে কয়েক ফুট দূরে সেই কাগজ এর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস নিলে সেটা নাকের ভেতর প্রবেশ করে ভিকটিমের দেহে কার্যকরী হয়।

 

উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া যায়, স্কোপোলামিন (Scopolamine, যা ‘Devil’s Breath’ নামেও পরিচিত)  ড্রাগটি মূলত অপারেশন পরবর্তী বিবমিষা এবং মোশন সিকনেসের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটির হ্যালুসিনোজেনিক বৈশিষ্ট্য থাকায় অনেক সময় মাদক হিসেবেও গ্রহণ করা হয়। অপরাধে এর ব্যবহার হিসেবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের Overseas Security Advisory Council (OSAC) ২০১২ সালে বিবৃতি দেয় যে, কলম্বিয়ায় ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে এবং বার ও নাইট ক্লাবে নারীদের উদ্দেশ্য করে স্কোপোলামিন ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ সময়ে এটি তরল বা পাউডার আকারে খাবার ও পানীয়তে মেশানো হয়।

তবে মিডিয়ায় ছিনতাই, অপহরণ, খুন ও ধর্ষণে স্কোপোলামিনের ব্যবহার অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়। চামড়ার মাধ্যমে শোষিত হয়ে দেহে কোনোরকম প্রভাব ফেলতে যতোটুকু ডোজের স্কোপোলামিন প্রয়োজন তা চামড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত লাগিয়ে রাখতে হবে।  এছাড়াও স্কোপোলামিন পাউডার কোনোভাবে মানুষকে সম্মোহিত বা ব্রেইনওয়াশ করে না, বরং কিছু সময়ের জন্য স্মৃতিভ্রম এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং ওয়েবসাইট Snopes ২০০৮ সালে অনুরূপ একটি গুজব নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৮ সালের মে মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ইমেইলের মাধ্যমে ‘অপরাধীরা স্কোপোলামিনে ভেজানো তীব্র গন্ধযুক্ত ভিজিটিং কার্ডের মাধ্যমে মানুষকে সম্মোহিত করে ফেলছে’ এমন একটি গুজব ছড়ানো শুরু হয়। কলম্বিয়ায় বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে স্কোপোলামিনের ব্যবহার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্ট্মেন্ট থেকে সতর্কবাণী প্রচারিত হলেও Snopes যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ সংঘটনে এর ব্যবহারের কোন সত্যতা খুঁজে পায় নি। গুজবে স্কোপোলামিনে ভেজানো তীব্র গন্ধযুক্ত ভিজিটিং কার্ডের কথা উল্লেখ করা হয়, অথচ স্কোপোলামিন একটি গন্ধহীন পদার্থ। অনুসন্ধানের পর Snopes এ দাবিটিকে মিথ্যা রেটিং দিয়েছে।

২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের এসেক্সের একজন পুলিশ অফিসারের বরাত দিয়ে একই গুজব ইমেইলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এসেক্স পুলিশ কর্তৃপক্ষ একটি পুরনো শহুরে কল্পকাহিনী গুজবের উদ্দেশ্যে ছড়ানো হচ্ছে বলে সতর্ক করে দেয়।

উইকিপিডিয়া ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় স্কোপোলামিন দিয়ে অপরাধ সংঘটনের ঘটনাকে শহুরে কল্পকাহিনী (Urban myth) বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

যেমন-ড্রাগস ডট কম এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্কোপোলামিন খাদ্য বা পানীয়ের সাথে মিশিয়া কাউকে খাওয়ালে সে কয়েক ঘন্টা অচেতন থাকতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র হাতের চামড়ায় লাগিয়ে কিংবা মুখে ছুড়ে মেরে কাউকে অজ্ঞান করা সম্ভব নয়।

কলম্বিয়ার সংবাদমাধ্যম বোগোটা পোস্ট এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলম্বিয়ায় স্কোপোলামিন এর সাহায্যে ছিনতাই বা বিভিন্ন রকমের অপরাধ খুবই সাধারন ঘটনা। তবে এখানে স্কোপোলামিন নিয়ে অনেক অতিরঞ্জিত গাল গল্পও প্রচলিত আছে। এর প্রভাবে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায় কিংবা সাময়িক স্মৃতিভ্রংশের শিকার হতে পারে, তবে ‘জোম্বি’দের মত আচরন করার যে কথা শোনা যায়, সেটা সম্পূর্ণই গুজব। ভিজিটিং কার্ড এর মাধ্যমে , কিংবা স্কোপোলামিন পাউডার মুখে ছুড়ে দিয়ে কাউকে ধরাশায়ী করা বলতে গেলে একেবারেই অসম্ভব।

গার্ডিয়ান পত্রিকার এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, European Monitoring Centre for Drugs and Drug Addiction কখনোই স্কোপোলামিন কে ভিজিটিং কার্ডের মাধ্যমে কিংবা নাকে প্রয়োগ করার কথা শোনেনি।

একই প্রতিবেদনে রসায়নবিদ ডক্টর লেস কিং জানিয়েছেন, স্কোপোলামিন খেলে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে । আশেপাশে কি ঘটছে সেটা মনে থাকবে না। তবে একই অনুভূতি পাওয়া যায় মদ কিংবা অন্যান্য নেশাদ্রব্যতেও। এর বাইরে স্কোপোলামিন এর ‘স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি’ কেড়ে নেওয়ার কোনো ক্ষমতা জানা নেই।

বাংলাদেশী লেখক মুরাদুল ইসলাম তার ব্যক্তিগত ব্লগেও জানাচ্ছেন, ‘এই স্কোপোলামিন কাউরে জোম্বির মত বানিয়ে ফেলবে এমন মনে করেন না এক্সপার্টেরা’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এর কর্মরত ডাক্তার Mahabuba Rahman-এর সাথে এ গুজবের ব্যাপারে কথা হয়। তিনি বলেন, তারা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ‘ রাস্তাঘাটে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া’ রোগী মাঝেমধ্যে পেয়ে থাকেন। তবে কোন কেমিকালের প্রভাবে তারা অজ্ঞান হচ্ছে, এসব কেমিকাল শরীরে কোন কোন উপায়ে প্রবেশ করছে (শরবতের সাথে মিশিয়ে, নাকে স্প্রে করে অথবা কাগজের মাখিয়ে) সে ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট Abidur Rahman বলেন, ২০১৫ সালে এই গুজব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাইরাল হয়েছিল। তখন বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন যে, এ ঘটনা ঘটা খুবই অপ্রত্যাশিত।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার Mashroof Hossain এটিকে গাঁজাখুরি গল্প হিসেবে অভিহিত করেন। স্কোপোলামিন বিষয়ক এই  ফেসবুক গুজব যে তৈরি করেছে,সে ভালো থ্রিলার লেখক হতে পারবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত

অনুসন্ধানের পর ফ্যাক্টওয়াচ একে মিথ্যা বলে অভিহিত করছে। স্কোপোলামিন সংক্রান্ত এই গুজবটি ২০০৮ সালে সর্বপ্রথম ইন্টারনেটে ইমেইলের মাধ্যমে ভাইরাল হয়, পরবর্তী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে ভাইরাল হয়। এর জের ধরে সম্প্রতি এবার বাংলাদেশে এটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তবে কাগজের সংস্পর্শ থেকে স্কোপোলামিন শরীরে প্রবেশ করে কাউকে অজ্ঞান করে ফেলার মত তথ্যপ্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি।

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

Leave a Reply