“সামিয়া সোহাগী স্কুল শিক্ষার্থী নন…”- শিরোনামে ভাইরাল দাবিটি আংশিক মিথ্যা।

Published on: December 5, 2021

সম্প্রতি ‘সোহাগী সামিয়া’ নামে এক ব্যক্তিকে নিয়ে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও এবং বেশ কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, এই ব্যক্তি স্কুল শিক্ষার্থী নয় বরং তার আসল পরিচয় তিনি ‘সমাজতান্ত্রিক দল’ এর ঢাকা নগরের প্রচার সম্পাদক। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম সারির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, ওই ব্যক্তির স্টুডেন্ট আইডি কার্ড, রেজিষ্ট্রেশন কার্ড এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংগঠনের বরাত দিয়ে জানা যায়, তিনি শিক্ষার্থী নন এই দাবিটি মিথ্যা এবং তবে এটি সত্য যে তার একটি রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে তবে সেই দলের নাম সমাজতান্ত্রিক দল নয় বরং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। তাই ফ্যাক্টওয়াচ দাবিটিকে ‘আংশিক মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।

এমন কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখান্‌ এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে



ভাইরাল ভিডিও এবং ছবিতে দাবি করা হয়, বর্ণিত ব্যাক্তিটি কোনো স্কুলের শিক্ষার্থী না হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি চলমান আন্দোলনে নেমে “উস্কানি” দিচ্ছেন। তার পরিচয় হিসেবে দাবি করা হয়, তার নাম সোহাগী সামিয়া এবং তিনি “সমাজতান্ত্রিক দল” এর ঢাকা নগরের দপ্তর সম্পাদক। ভিডিওতে, একটি মিছিলে স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েকজন এবং তাদেরকে ঘিরে পুলিশের পোশাকধারী কয়েকজনের বাকবিতণ্ডাও দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে একটি ফেসবুক আইডির স্ক্রিনশটও দেখানো হয়। এছাড়াও “Bd Viral News” নামের একটি লোগো ভিডিওর ডান পাশের কোণায় দেখা যাচ্ছে।

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

ভিডিওতে বিদ্যমান লোগোটির সাথে মিল রেখে “BD Viral News” নামে একটি ফেসবুক পেজ পাওয়া যায়।যেখানে ৩ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে প্রকাশিত এই ভিডিওটি পাওয়া যায়। ভিডিও ছাড়াও এই পেজ থেকে একই দিনে একটি পোস্টার সহ দুইটি ফেসবুক পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে মূলত এই দাবিগুলোই ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এই পোস্টগুলো এবং ভিডিওর দাবিটি একই। সেখানে বলা হচ্ছে,

ইনি স্কুল শিক্ষার্থী না

আসল পরিচয় সমাজতান্ত্রিক দলের ঢাকা নগরের দপ্তর সম্পাদক সোহাগী সামিয়া সাধারণ স্কুল শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করলেও স্কুলের ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় নেমে উস্কানি দিচ্ছে। বারবার নিজেকে স্কুল শিক্ষার্থী দাবি করলেও দেখাতে পারেনি কোন আইডি কার্ড

কারও উস্কানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে সচেতন থাকুন

#শিক্ষার্থী #উস্কানি #আন্দোলন“।

 

এখানে প্রথম দাবি অনুযায়ী, সোহাগী সামিয়া নামের ব্যক্তিটি স্কুল শিক্ষার্থী নয়। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন কি-ওয়ার্ডের মাধ্যমে গুগল সার্চ করা হলে বাংলাদেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন সামনে আসে। দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত ৪ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে ” Schoolgirl killed, road safety demo continues” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে সোহাগী সামিয়াকে (Shohagi Samia) খিলগাঁও মডেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “Khilgaon Model College student Shohagi Samia, who led the protest, said, “The protest cannot be stopped by any threat or fear. This protest will continue in realising the 11-point demand.” “। এই প্রতিবেদনে দেওয়া ছবির সাথে বর্তমানে ভাইরাল ভিডিওতে দেখানো মেয়েটির মিল পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, ০২ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে প্রথম আলো ” শরীরে তিতুমীর, প্রীতিলতার রক্ত, হুমকি-ধামকি ভয় পাই না” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও ‘সোহাগী শামীয়া’কে শিক্ষার্থী হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত ছবির সাথেও বর্তমানে ভাইরাল ছবি বা ভিডিওর মিল পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে সোহাগী সামিয়া এবং সেঁজুতি খন্দকার নামের দুইজন ব্যক্তির একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়।

সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়ুন এখানে।

এছাড়াও দৈনিক ইত্তেফাকে ৩ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে “শনিবারও সড়কে থাকবে শিক্ষার্থীরা, ‘লাল কার্ড’ দেখানোর ঘোষণা” শিরোনামে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনেও সোহাগী সামিয়াকে খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আবার “সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা মহানগর শাখা” নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে ০৩ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে দেওয়া একটি পোস্ট থেকে সোহাগী সামিয়া নামক ওই ব্যক্তির স্টুডেন্ট আইডিকার্ড এবং এইচএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যায়, তার পুরো নাম “Shohagi Samia Jannatul Ferdous” এবং তিনি খিলগাঁও মডেল ইউনিভার্সিটি কলেজের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী।

বাসদ বরিশাল শাখার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তীও একই ছবি এবং তথ্যসংবলিত একটি ফেসবুক পোস্ট প্রকাশ করেন।

এছাড়াও নিউজবাংলা নামে একটি ওয়েবপোর্টালে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারেও খিলগাঁও মডেলে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সামিয়া নিজে। তিনি বলেন, “যে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে সেটা আমারই। অনেকে বলছেন আমি শিক্ষার্থী নই, এটি আসলে আন্দোলন থামিয়ে দিতে প্রচার করা হচ্ছে। আমি খিলগাঁও মডেল ইউনিভার্সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় আগামী ১৯ তারিখ আমার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে।“

পুরো প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে

অর্থ্যাৎ, সোহাগী সামিয়া শিক্ষার্থী নন এই দাবিটি মিথ্যা কারণ তিনি খিলগাঁও মডেল ইউনিভার্সিটি কলেজের শিক্ষার্থী।

অন্যদিকে দ্বিতীয় দাবিটি হচ্ছে, সোহাগী সামিয়া সমাজতান্ত্রিক দলের ঢাকা নগরের দপ্তর সম্পাদক তথা তার একটি রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। ভাইরাল ভিডিওটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে দেখানো একটি দৃশ্যের সাথে শিরোনাম ও ভিডিওতে ব্যবহৃত কন্ঠস্বরের মধ্যে একটি পরষ্পর বিরোধিতা রয়েছে। ভিডিওতে দেওয়া কন্ঠস্বর কিংবা এর শিরোনামে বলা হচ্ছে, বর্ণিত ব্যক্তিটি “সমাজতান্ত্রিক দল” নামে একটি দলের ঢাকা নগরের দপ্তর সম্পাদক। কিন্তু ভিডিওতে দৃশ্যমান স্ক্রিনশটে দেখা যায় দলটির নাম “সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট”। এছাড়াও ভাইরাল অন্যান্য ছবি বা পোস্টারেও তার দলের নাম হিসেবে “সমাজতান্ত্রিক দল” উল্লেখ করা হচ্ছে।

এই বিষয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা মহানগর শাখা’ থেকে প্রকাশিত ফেসবুক পোস্ট থেকে ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, “এই আন্দোলন করতে করতেই সোহাগী যুক্ত হয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাথে। বর্তমানে সে ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা নগর কমিটির দপ্তর সম্পাদক।“এছাড়াও ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তীর দেওয়া পোস্ট থেকেও এই তথ্যটি পাওয়া যায়।

অন্যদিকে একই পেজ থেকে গত ০২ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে দেওয়া একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘বার্তা প্রেরক’ হিসেবে সোহাগী সামিয়ার নাম এবং পদবী উল্লেখ করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিটি দেখুন এখানে

 

অর্থ্যাৎ, এটি প্রমাণিত যে সোহাগী সামিয়ার একটি রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে তবে সেই দলটির নাম সমাজতান্ত্রিক দল নয় বরং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।

পরিশেষে দেখা যাচ্ছে, উপরোল্লিখিত ভাইরাল ভিডিও এবং পোস্টগুলোতে দেওয়া তথ্যের মধ্যে কমপক্ষে দুইটি অসংগতি রয়েছে। ১) সোহাগী সামিয়া শিক্ষার্থী নয়। এই তথ্যটি ভুল কারণ তিনি পরিষ্কারভাবেই খিলগাঁও মডেল ইউনিভার্সিটি কলেজের শিক্ষার্থী্। ২) তিনি ” সমাজতান্ত্রিক দল” এর ঢাকা নগরের দপ্তর সম্পাদক। এটি সত্য যে তার একটি রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে তবে সে দলটির নাম সমাজতান্ত্রিক দল নয় বরং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। তাই এই অসংগতিগুলো বিবেচনায় নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্ট এবং ভিডিওগুলোকে ‘আংশিক মিথ্যা’ চিহ্নিত করছে।

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

Leave a Reply